ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় যে সকল কৃষক বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে ফরাজি আন্দোলন অন্যতম। এই আন্দোলন ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার নিদর্শন।
সময় কাল | ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ |
এলাকা | বারাসাত, বরিশাল, ফরিদপুর, যশোহর, মালদহ, পাবনা, ঢাকা |
নেতৃত্ব বৃন্দ | হাজী শরীয়ত উল্লাহ, দুদু মিয়াঁ (মোহাম্মদ মুসিন), নোয়া মিয়াঁ (আব্দুল গফুর) |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
আন্দোলনের উৎপত্তি
১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর নিবাসী হাজী শরীয়ত উল্লাহ (১৭৮১ – ১৮৩৭) মুসলিম ধর্মের পুনরুজ্জীবন এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন।
শরীয়ত উল্লাহ খুব অল্প বয়সেই হজ করার জন্য মক্কা যান এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
স্বদেশী ফিরে এসে তিনি তার উপলব্ধির কথা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন এবং ধর্মীয় সংস্কারকের ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
ধীরে ধীরে শরীয়ত উল্লাহর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
আদর্শ
এই আন্দোলনের আদর্শ ছিল-
১) ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা।
২) পবিত্র কোরআনের আদর্শ অনুসরণ করে ইসলাম নির্দিষ্ট কর্তব্য ও বিশ্বাস মেনে চলা।
৩) ‘তারিকা ই মোহাম্মাদীয়া‘ বা মোহাম্মদ নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা এবং একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।
রাজনৈতিক রূপ
ফরাজি আন্দোলন প্রথম দিকে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলেও পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিতে শুরু করে।
শরীয়ত উল্লাহ প্রভাব মুসলমান কৃষক ও সাধারণ মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কৃষক ও সাধারণ মানুষদের উপরও পড়তে শুরু করে।
তিনি তার অনুগামীদের জমিদার ও নীলকর সাহেবদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। অচিরেই বাংলার কৃষকদের মধ্যে জাগরণের সঞ্চার হয়।
শরীয়ত উল্লাহ ইংরেজ অধিকৃত ভারতকে “দার উল হারব” বা শত্রুদের দেশ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন এই দেশ ইসলাম ধর্মলম্বী মানুষদের বসবাসের অনুপযুক্ত।
ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলাগুলিতে কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদের মধ্যেও এই আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
দুদু মিয়াঁর ভূমিকা
শরীয়ত উল্লাহ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের দায়িত্ব নেন তার সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ মুসিন। ইতিহাস তাকে চেনে দুদু মিয়াঁ নামে। তার নেতৃত্বেই ফরাজি আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও বিধিবদ্ধভাবে গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন ব্যক্তি। ফরাজি আন্দোলনের তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গুলি হল-
১) আন্দোলনের গতিপথ
শরীয়ত উল্লাহের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের প্রভাব গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে ইতিমধ্যে জাগরণ সঞ্চার করেছিল। দুদু মিয়াঁ সেই জাগরণকে বৈপ্লবিক স্তরে উন্নতি করে ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে চালিত করেন। কৃষক শ্রমিক কারিগর ও শতদরিদ্র নির্যাতিত মানুষেরা দলে দলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
২) দুদু মিয়াঁর আহ্বান
সাংগঠন ও আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে দুদু মিয়াঁ বাহাদুরপুরে কেন্দ্র স্থাপন করে পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে অর্থ সংগ্রহের জন্য ‘খলিফা‘ নিয়োগ করেন। তিনি ঘোষণা করেন মানুষ ঈশ্বরের সন্তান। মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। জমির মালিক ঈশ্বর, সুতরাং জমিদারদের খাজনা আদায়ের কোন অধিকার নেই। তিনি তার অনুগামীদের খাজনা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে ও ইংরেজদের অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানান।
৩) ভিন্ন বিচার ব্যবস্থা
দুদু মিয়াঁ গ্রামে গ্রামে ভিন্ন আদালত প্রতিষ্ঠা করেন এবং বর্ষীয়ান ধর্মজ্ঞানী কৃষকদের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি গ্রামীণ নিপীড়িত কৃষকদের সরকারি আদালতে যেতে বিরত থাকতে বলেন এবং কৃষকদের মধ্যে কোন বিরম্বনা উপস্থিত হলে ওই আদালতে তা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হত।
৪) ফরাজী খিলাফত
দুদু মিয়াঁ ফরাজি খিলাফত নামে একটি সুশৃংখল প্রশাসন গড়ে তোলেন।
এই প্রশাসনের শীর্ষ প্রশাসক ছিলেন তিনি, যাকে বলা হতো ওস্তাদ। ওস্তাদকে সাহায্যকারী দলকে বলা হত খলিফা।
খলিফাদের প্রধান কাজ ছিল নিজে এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করা ও আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা।
৫) জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন
দুদু মিয়াঁ একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন এবং অত্যাচারিত কৃষক ও সাধারণ মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হন।
বারাসাত, যশোহর, মালদহ, পাবনা, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে থেকেই এই আন্দোলন ক্রমশ নীলকর, জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করতে শুরু করে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিয়াঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিয়াঁর মৃত্যুর পর ফরাজী আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে।
তার পুত্র আব্দুল গফুর (নোয়া মিয়াঁ) আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মূলত নোয়া মিয়াঁ এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দিকের উপর গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে ধর্মীয় আদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করলে এই আন্দোলন তার গতিপথ হারায়।
উপসংহার
ইসলামের আদর্শকে সামনে রেখে সংগঠিত করা ফরাজি আন্দোলন প্রথমদিকে ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে এই আন্দোলন ধর্মের সংকীর্ণ গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। দুদু মিয়াঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমান কৃষকদের একটি বৃহৎ অংশকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এটা অনস্বীকার্য যে ফরাজি আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তীকালে নানান কৃষক আন্দোলনে প্রেরণা যোগায়।