সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফল

দীর্ঘদিন ব্রিটিশের হাতে জর্জরিত শোষিত এবং অত্যাচারিত ভারতবাসীদের ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশই হল সিপাহী বিদ্রোহ। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত হয় সিপাহী বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

১) আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা

সিপাহী বিদ্রোহকে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে ভারতের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়।

এই সংগ্রামের হাত ধরে আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। অত্যাচারিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এটাই হল প্রথম যথার্থ স্বাধীনতা সংগ্রাম।

বিদ্রোহী নেতা-নেত্রী সিপাহীদের অদম্য সাহস, দেশপ্রেম বীরত্ব সকল ভারতবাসীদের মনে যে যে আড়োলন সৃষ্টি করেছিল

সেই অনুপ্রেরণা পরবর্তীকালের নানান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে।

এই বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন ঘটে।

মহাবিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্যার লেপেল গ্রিফিন মন্তব্য করেন “১৮৫৭ সালের আগে ভারতের পক্ষে মঙ্গলময় এইরূপ ঘটনা কখনো ঘটেনি“।

২) কোম্পানি শাসনের অবসান

সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন নীতির উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে।

একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের উপর ভারতের শাসনভার বহাল রাখা আর নিরাপদ এই উপলব্ধি করে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ২রা আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আইন পাস করে ভারতের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে সরিয়ে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে অর্পণ করেন।

৩) ভাইসরয় নিয়োগ

বোর্ড অফ কন্ট্রোলের জায়গায় ব্রিটিশ কেবিনেট মন্ত্রীদের মধ্যে একজনকে ভারত সচিবের পদে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল গঠিত হয়, যারা এক একটি দপ্তর সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সিংহাসনের অর্থাৎ মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি  হিসেবে গভর্নর জেনারেলকে “ভাইসরয়” হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।

৪) স্বত্ববিলোপ নীতির অবসান

বহু কুখ্যাত এবং সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত স্বত্ববিলোপ নীতির অবসান ঘটানো হয়।

৫) দেশে রাজ্যগুলির সম্পর্কে নতুন নীতি

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ১লা নভেম্বর মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রটি নব নিযুক্ত ও সর্বপ্রথম ভাইসরয় লর্ডস ক্যানিং এলাবাদের এক প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে পাঠ করেন। তাতে উল্লেখিত ছিল যে-

i) স্বত্ববিলোপ নীতি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত করা হলো।

ii) ব্রিটিশ সরকার ভারতে রাজ্য বিস্তার নীতি পরিত্যাগ করবেন।

iii) দেশীয় রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হল।

iv) দেশীয় রাজাদের সঙ্গে কোম্পানির যেসব চুক্তি ও সন্ধি পূর্বে সম্পাদিত হয়েছে সেগুলির মান্যতা দেওয়া হবে।

v) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দেশীয় রাজ্যগুলিতে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধ উপস্থিত হলে গভর্নর জেনারেলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

vi) দেশীয় রাজ্যগুলির অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে তা ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্য করবে।

vii) ভারতের ধর্মীয় এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশ সরকার কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।

viii) জাতি ধর্ম ও নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করা হবে।

৬) শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে প্রবর্তিত ৭) সামরিক সংস্কারকেন্দ্রীয়করণ নীতি ১৮৬১ সালে পরিত্যক্ত করা হয়। বোম্বাই এবং মাদ্রাস কাউন্সিলকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয় এবং এই নতুন কাউন্সিল আইন অনুসারে ভারতের নতুন আইনসভা গঠিত করা হয়।

শাসন কার্যের সুবিধার্থে ১৮৭০ সালে সমুদ্র গর্ভ (লোহিত সাগর) দিয়ে টেলিগ্রাফ তারের মাধ্যমে ভারত এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।

৭) সামরিক সংস্কার

সামরিক বিভাগকে নতুন রুপে গঠন করা হয়। সেনাবাহিনীতে ইউরোপীয় এবং ইংরেজ সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় অপরপক্ষে ভারতীয় সেনা নিয়োগ কমিয়ে দেওয়া হয়।

গোয়েন্দা বাহিনীতে শুধুমাত্র ইংরেজ সেনা ব্যথিত ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। তাছাড়া সীমান্ত রক্ষা অভ্যন্তরীণার্থী শান্তিরক্ষার ভার ইংরেজ ও ইউরোপীয় সামরিক কর্মচারীদের উপর অর্পণ করা হয়।

৮) বিভাগ ও বিভেদ নীতি

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাগ ও বিভেদ নীতি অবলম্বন করে এবং প্রচ্ছলভাবে ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে পুনরায় ঐক্য না গড়ে ওঠে।

৯) মোগল সাম্রাজ্যের অবসান

সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রায় ৩৩২ বছর ধরে রাজত্ব করা মোগল সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রেঙ্গুনে পাঠানো হয় এবং তার পুত্র পৌত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

১০) সামাজিক পরিবর্তন

সিপাহী বিদ্রোহের দমনের পর ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কুসংস্কার বর্জিত, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতীয় সমাজে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুরা পাশ্চাত্য সাহিত্য ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির উপর আকর্ষণ অনুভব করুন এবং আধুনিকতার পথে অগ্রসর হয়।

১০) বিদ্রোহের সুফল ও কুফল

বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকার চরম নিষ্ঠুরতা পরিচয় দিয়েছিল। বিদ্রোহীদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়াও বিদ্রোহীদের সাহায্যাকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সরকারি কর্মচারীকে শাস্তি ও পদ থেকে ছাঁটাই করা হয়।

এছাড়াও-

i) বিদ্রোহের পর শাসক ও শাসিতদের মধ্যে যে প্রবল তিক্ততা সৃষ্টি হয় তা বহুদিনব্যাপী বলবৎ ছিল।

ii) ইন্দো-ইউরোপীয় সভ্যতার যে আদর্শ গড়ে উঠেছিল তা প্রবলভাবে আঘাত পায় এবং ক্রমে বিলীন হয়ে যায়।

iii) ব্রিটিশ সরকার যতই ভারতীয়দের প্রতি সহৃদয় দেখাক প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই ভারতবাসীদের মনে সহযোগিতার পরিবর্তে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা শুরু হয়।

iv) ভারতবাসীদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করে।

v) সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার প্রতিক্রিয়াশীল নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে।

উপসংহার

বস্তুপক্ষকে সিপাহী বিদ্রোহ তাৎক্ষণিক সুফল না পেলেও পরবর্তী সময়ে এই বিদ্রোহের হাত ধরেই ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ড আরো জোরদার হতে শুরু করে।

ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটে। অপরপক্ষে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উন্মেষ ঘটে যা পরবর্তীকালের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *