বদ্বীপ
মোহনায় স্রোতের বেগ কম হওয়ার জন্য নদী বাহিত পলি, কাদা, বালি ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হয়ে কালক্রমে মাত্রাহীন ব বা গ্রিক অক্ষর ডেল্টার (Delta) ন্যায় ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, একে বদ্বীপ বলে।
বদ্বীপের উৎপত্তি কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যথা- ১) নদী প্রবাহের মাত্রা ২) ঋতুভিত্তিক নদীবর্তন, ৩) বস্তু ভারের পরিমাণ ৪) সমুদ্র তলের ঢাল, ৫) মোহনার আকৃতি প্রভৃতি নিয়ন্ত্রক গুলির উপর নির্ভর করে আকৃতি ও গঠন অনুসারে বদ্বীপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
1) ধনুকাকৃতি বদ্বীপ (Arcuate Delta)
যে সমস্ত ব দ্বীপ সমুদ্রের দিকে উত্তল প্রান্ত বিশিষ্ট বা সমুদ্রমুখী বহি রেখা ধনুকের মতো বিস্তৃত থাকে তাকে ধনুকাকৃতি বদ্বীপ বলে
উৎপত্তি
প্রধান নদী ও শাখা নদী মিলন স্থলে, মূল নদীটি দুই পাশে শাখা নদী চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়। এর ফলে মূল নদীটির সঞ্চয় কার্য সমুদ্রের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায় এবং শাখা নদীগুলির সঞ্চিত পলিরাশি বিপরীতমুখী নানান সামুদ্রিক শক্তি যেমন জোয়ার ভাটা, স্রোত প্রভৃতি দ্বারা স্থলভাগের দিকে সংকীর্ণ হয়ে ধনুকতাকৃতি ব-দ্বীপের সৃষ্টি করে।
বৈশিষ্ট্য
১) মূল নদী দুইপাশে শাখা নদী গুলির চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয় এবং সঞ্চয়জাত পদার্থ সমুদ্রের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায়। ফলে এই ধরনের বদ্বীপ গুলির মধ্যভাগ সমুদ্রের দিকে বাড়ানো ও স্থলভাগের দিকে সংকীর্ণ হয়।
২) এই বদ্বীপ নুড়ি, বালি, কাদার স্তর প্রভৃতি ভারি পদার্থ দিয়ে তৈরি।
৩) এই বদ্বীপ গঠনে সমুদ্র ও নদীর শক্তি ভিন্ন অভিমুখে কাজ করে।
৪) সমুদ্র নদীর জলের ঘনত্ব সমান হলে এই ধরনের বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
৫) এই ধরনের ব দ্বীপ প্রতি বছর সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয় বলে একে বর্ধনশীল বদ্বীপ বলে।
উদাহরণ
গঙ্গা, ইরাবতী, গোদাবরী, মহানদী, পো, হোয়াংহো, নীল প্রভৃতি নদীর মোহনায় এই ধরনের বদ্বীপ দেখা যায়।
2) তীক্ষ্ণাগ্র বা কাসপেট বদ্বীপ (Cuspate Delta)
এই বদ্বীপের ক্ষেত্রে মূল নদীর মোহনাটি করাতের দাঁতের মতো দেখতে হয় তাকেতীক্ষ্ণাগ্র বা কাসপেট বদ্বীপ বলে।
লাতিন শব্দ ‘কাসপেটের’ অর্থ হল তীক্ষ্ণ।
উৎপত্তি
পুরোদেশীয় দুটি স্পিট দু দিক থেকে বাড়তে বাড়তে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাসপেট স্পিট গঠন করে।
এই কাসপেট স্পিট ধারাবাহিকভাবে সমুদ্রের দিকে বিস্তৃত হয়ে ক্রমশ ত্রিকোনাকার আকৃতি ধারণ করে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে মূল নদী স্রোত সমুদ্রের মধ্যে অনেকদিন পর্যন্ত প্রবাহিত হলে সঞ্চিত পলিরাশি নানান সামুদ্রিক শক্তি যেমন জোয়ার ভাটা, সমুদ্র স্রোত প্রভৃতির আঘাতে মাঝখান থেকে দু দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং করাতের দাঁতের মতো তীক্ষ্ণ বদ্বীপ সৃষ্টি করে
বৈশিষ্ট্য
১) এই ধরনের বদ্বীপগুলির শীর্ষদেশটি দিকে থাকে।
২) মূল নদীর মোহ নাকি সমুদ্রের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায়।
৩) নদী শক্তির চেয়ে সামুদ্রিক শক্তি বেশি কার্যকরী হলে এই ধরনের বদ্বীপ সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ
ইতালির তাইবার নদী, স্পেনের এব্রো নদী, ভারতের সুবর্ণরেখা নদী এই ধরনের বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে।
3) পাখির পায়ের ন্যায় বদ্বীপ (Bird foot Delta)
নদীবাহিত পলি রশি নদীর মোহনায় সঞ্চিত হয়ে পাখির পায়ের মতো আকৃতি বিশিষ্ট ব-দ্বীপ সৃষ্টি করলে তাকে পক্ষী পদ বদ্বীপ বা পাখির পায়ের ন্যায় বদ্বীপ বলে।
উৎপত্তি
অধিক গতি সম্পন্ন নদী ও তার শাখা নদী গুলির পলিরাশি সমুদ্রে বহুদূর অবধি সঞ্চিত হয়, সমুদ্র জলের ঘনত্বের তুলনায় নদীর জলের ঘনত্ব কম থাকায় নদী প্রবাহের দুই দিকে পলি সঞ্চিত হয়ে পাখির পায়ের মতো ব দ্বীপ গড়ে তোলে।
বৈশিষ্ট্য
১) এইরূপ বদ্বীপ সাধারণত সূক্ষ্ম পলি ও বালি দ্বারা গঠিত।
২) এই ধরনের বদ্বীপগুলি পাখির পায়ের মতো দীর্ঘ ও সংকীর্ণ হয়ে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়।
৩) মূল নদী অনেকগুলি শাখায় বিভক্ত হয়ে সমুদ্রের দিকে প্রসারিত হয়ে থাকে।
৪) মোহনায় ভূমির অধিক ঢাল ও অধিক গতি সম্পন্ন নদী প্রবাহ এই বদ্বীপ গঠনে সাহায্য করে।
৫) এরূপ বদ্বীপ গঠনে নদী শক্তির প্রাবল্য সামুদ্রিক শক্তির তুলনায় অধিক হয়।
উদাহরণ
মিসিসিপি নদীর বদ্বীপ, ভারতের কৃষ্ণা নদীর ব দ্বীপ পাখির পায়ের ন্যায়।
4) খাঁড়ীয় বদ্বীপ (Estuary Delta)
যে সমস্ত ব দ্বীপ সমুদ্রের দিকে উত্তলাকারে অবস্থান করে, তাকে খাঁড়িও বদ্বীপ বলে।
উৎপত্তি
নদীর মোহনায় কোন খাঁড়ী সৃষ্টি হলে, নদীবাহিত পলিরাশি সঞ্চিত হয়ে যে বদ্বীপ সৃষ্টি করে তা ঐ খাঁড়ীতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
বৈশিষ্ট্য
১) এই ধরনের ব দ্বীপ যে খাড়িতে সৃষ্টি হয় সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে, সমুদ্রের দিকে উত্তল আকারে এগিয়ে আসে না।
২) এই বদ্বীপ সংকীর্ণ হয়ে থাকে।
উদাহরণ
জার্মানির রাইন, ফ্রান্সের সিন নদীতে এই ধরনের বদ্বীপ গঠিত হয়েছে