ছাপাখানা বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান

আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর চৌধুরী। তিনি একাধারে লেখক, সুরকার, চিত্রকর, প্রকাশক এবং সফল উদ্যোগপতি ছিলেন। তিনি হাফ-টোন পদ্ধতি ও রঙিন ব্লক এর সূচনা করে বাংলায় মুদ্রন শিল্পে বিপ্লব এনেছিলেন। তাই বাংলা তথা সমগ্র ভারতের ছাপাখানার ইতিহাসে উপেন্দ্রকিশোর চৌধুরী একটি অবিস্মরণীয় নাম।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৮৬৩ সালের ১০ই মে ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামের বনেদি রায় পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈতৃক নাম কামদারঞ্জন রায়। পিতা ছিলেন কালিনাথ রায়, যিনি পাণ্ডিত্যের জন্য মুন্সী শ্যামসুন্দর নামে পরিচিত ছিলেন। শ্যামসুন্দরের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন কামদারঞ্জন রায়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শ্যামসুন্দরের নিকট আত্মীয় নিঃসন্তান জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী কামদারঞ্জন রায়কে দত্তক নেয় এবং তাঁর নামবদল হয়। তখন থেকেই কামদারঞ্জন রায় হয়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

শিশুসাহিত্যি উপেন্দ্রকিশোরের আবির্ভাব

আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃৎ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি পড়াশোনার জন্য মসূয়া ছেড়ে কলকাতায় আসেন। সেই সূত্রে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল উপেন্দ্রকিশোরের।

ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’, শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘মুকুল’ প্রভৃতি পত্রিকা ছোটদের জন্য প্রকাশিত হতো। এই সব পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোরকে শিশুসাহিত্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি এই সব পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

উপেন্দ্রকিশোরের লেখা প্রথম দুটি বই ‘ছেলেদের রামায়ন’ এবং ‘মাহাভারত’ যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছাপাখানা থেকে প্রকাশ পেয়েছিল।

তবে এই সমস্ত বইয়ের ছবি উপেন্দ্রকিশোরের পছন্দ হয়নি। তিনি ছোটদের উপযোগী বই প্রকাশের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বিলেত থেকে ছোটদের বই এবং মুদ্রনের উন্নত সরঞ্জাম আনিয়ে নিজেই বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে উন্নত হাফটোন ব্লক তৈরি করেছিলেন। তারপর নিজের বাড়িকেই ছাপাখানা বানিয়ে শুরু করেছিলেন বই ছাপানোর কাজ। তাঁর হাত ধরেই বাংলা তথা ভারতের মুদ্রণ শিল্পে বিপ্লব এসেছিল।

মুদ্রণ বিষয়ক গবেষণা

শিশুদের উপযোগী বই প্রকাশ করার কাজে উপেন্দ্রকিশোর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সে সময় শিশুদের বইয়ে কোনো ছবি থাকতো না। অন্যদিকে ইউরোপে ছোটদের বই প্রকাশিত হতো নানা ছবিতে শোভিত হয়ে। বাংলা ভাষায় ছোটদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সে রকম সৌন্দর্যের অভাব তাঁকে পীড়া দিয়েছিল বলে, এর প্রকাশনাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিলেন আরেক শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার

চিত্রশিল্পী ও লেখক হওয়ার দরুন ছাপাখানা ও প্রকাশনা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল। উপেন্দ্রকিশোর দীর্ঘকাল ছবি মুদ্রনের উন্নত কলাকৌশল সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন। বিলেতের বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা পেনারোজ এনুইয়েল-এ উন্নত মুদ্রণপদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। বড় ছেলে সুকুমার রায়কে আধুনিক ছাপাখানার কলাকৌশল শেখার জন্য বিলেত পাঠিয়েছিলেন এবং নিজে বাড়িতে বসে মুদ্রণ সম্পর্কে দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন।

ইউ এন রায় এন্ড সন্স-র প্রতিষ্ঠা

ছাপাখানা ও ছবি এনগ্রেভিং বিষয়ে তাঁর দক্ষতা কাজে লাগাবার জন্য ১৮৯৫ সালে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতার শিবনারায়ন দাস লেনের নিজ বাড়িতে খুলে ফেলেন ছাপাখানা। যা পরবর্তীতে ইউ এন রায় এন্ড সন্স নামে পরিচিতি লাভ করে। এই প্রেসে যত্ন করে ছোটদের জন্য আকর্ষণীয় ছবি সম্বলিত উন্নতমানের বই প্রকাশিত হতে লাগলো।

হাফটোন ব্লক পদ্ধতির উদ্ভাবন

মুদ্রণ শিল্পকে উন্নত করতে নিজ বাড়িতে বসে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান উপেন্দ্রকিশোর। এরপর অন্ধকার ঘরে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরন লক্ষ্য করে তিনি নতুন প্রিন্টিং পদ্ধতির সূত্র আবিস্কার করে ফেলেন, যা হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি বই ছাপার কাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলা তথা ভারতের মুদ্রণ শিল্পে উন্নতিসাধন করেন।

রঙিন ছবির ব্যবহার

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর নিজের ছাপাখানা থেকে বইয়ের মধ্যে রঙিন ছবি মুদ্রনের জন্য নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান।

বইয়ের প্রচ্ছদে ও ভিতরের অংশে রঙিন ছবি ছাপার জন্য ৬০ ডিগ্রি স্ক্রীন, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়াফর্ম সিস্টেম, ডুয়োটাইপ ও টিন্ট প্রসেস পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। তাঁর তৈরি স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্রের নাম হয় ‘রে স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার’ এবং টিন্ট প্রসেসের নাম হয় ‘রে টিন্ট প্রসেস’। এই সমস্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে রঙিন ছবি যুক্ত বই ছাপানো শুরু হয়। বাঙালি শিশুদের চোখ জুড়িয়ে গেল সেই সব ছবি দেখে।

স্টুডিও নির্মাণ

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ফটোগ্রাফিকে মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করে বই ও পত্রিকাকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তুলতে ছেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে নির্মাণ করেন স্টুডিও এবং এখানে তিনি আধুনিক ফটোগ্রাফি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। পুত্র সুকুমার রায়কে আধুনিক ছাপাখানার কলাকৌশল শেখানোর জন্য ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডে পাঠান।

বই প্রকাশ

ইউ এন রায় এন্ড সন্স প্রতিষ্ঠার পর শিশুসাহিত্যের নতুন দরজা খুলে গেল। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর নিজের প্রকাশনা থেকে শিশুদের জন্য একের পর এক রঙিন বই প্রকাশ করতে লাগলো।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল ‘ছেলেদের রামায়ন’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘টুনটুনির বই’ ইত্যাদি।

১৯১০ সালে প্রকাশিত ‘টুনটুনির বই’ এখনও বাংলা ভাষায় শিশুদের ভালো বইগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশ পায় শিশুদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’। এই পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোর শুধু নিজে লিখলেন না, পত্রিকাকে ঘিরে তৈরি হল নতুন নতুন লেখক গোষ্ঠী। যারা পরবর্তীতে বাংলা শিশুসাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

উপসংহার

১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এরপর তাঁর বড় ছেলে সুকুমার রায় ইউ এন রায় এন্ড সন্স-কে এগিয়ে নিয়ে যান।

উপেন্দ্রকিশোর কেবলমাত্র ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে অর্থ উপার্জনের জন্য ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিশুদের হাতে রঙিন ছবি যুক্ত আকর্ষণীয় বই তুলে দেওয়া। সে কাজে তিনি সফল হয়েছেন।

নিজে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে বই প্রকাশ করে ছাপাখানার জগতে নতুন বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ইউ. এন রায় এন্ড সন্স শুধু ভারতে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ছাপাখানা হয়ে রয়েছে। তাই বাংলা তথা ভারতের ছাপাখানার বিকাশ আলোচনা করতে গিয়ে বারে বারে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ.এন রায় এন্ড সন্স এর নাম উঠে আসে।

ছাপাখানা বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান - Portrait Drawing - Shovan Singh -

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *