উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন ছিল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সংজ্ঞায়িত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদিত ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান ও বাকি অঞ্চল নিয়ে ভারত নামক দুটি নব রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৭-র বিভাজনের দরুন এক মানবিক বিপর্যয় ঘটে। যার প্রভাব আজও অব্যাহত।

নব গঠিত ভারতের কাছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল উদ্বাস্তু সমস্যা। ভারত ভাগের ফলে বহু মানুষ বিশেষত হিন্দু ও শিখরা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসতে শুরু করে। এর ফলে ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা গভীর ভাবে দানা বাঁধে। স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু সমস্যা ভারতে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল। তবে ভারত সরকার এই সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। 

ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা

উদ্বাস্তু শব্দের অর্থ ‘বাস্তু থেকে উৎখাত’ বা ‘বাস্তুচ্যুত’। মূলত যুদ্ধ, দাঙ্গা, জাতিগত হিংসা, নিরাপত্তা হীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি কারনে নিজ দেশ বা মাতৃভূমি বা বাস্তু ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় বা যেতে বাধ্য করা হয়, তাদের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী (Refugee) বলা হয়।

ভারতের ক্ষেত্রে উদ্বাস্তু বলতে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগ্রত মানুষদের বোঝায়। দেশ ভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় ও ঘরছাড়া হয়ে বাসস্থান ও নিরাপত্তার খোঁজে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেয়। উদ্বাস্তুরা পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা সহ একাধিক রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরা উদ্বাস্তু হয়ে পাঞ্জাব, রাজস্থান, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে চলে আসে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলি, দিনাজপুর, মালদহ ছাড়াও আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে।

দেশ বিভাজনের পূর্বে যে হিন্দু, মুসলমান, শিখদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, দেশ ভাগের পরেই সেই দাঙ্গা আবার মাথাচাড়া দেয়।  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পাশপাশি উদ্বাস্তু সমস্যা তৎকালীন ভারতকে জর্জরিত করে তোলে। যে সাম্প্রদায়িক কারনে দাঙ্গা বাঁধে, সেই সাম্প্রদায়িক কারনে লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়য়। দেশ বিভাগের ফলে সীমান্ত এলাকাগুলিতে বহু হিন্দু, মুসলমান পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ও নেতাদের সিদ্ধান্তে নিজেদের  বাসভূমিতে তারা উদ্বাস্তু বলে চিহ্নিত হয়।

বাড়িঘর, জমি জায়গা সব ত্যাগ করে মুসলমানরা পাকিস্তানে ও হিন্দুরা ভারতবর্ষে চলে আসতে বাধ্য হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখদের উপর অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড চলে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভয়ে সবকিছু হারিয়ে কেবল জীবন হাতে নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এদিকে নির্যাতিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দুরা  পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করে। আসাম ও ত্রিপুরার সীমান্ত ধরে প্রচুর হিন্দু ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে আগত এই সমস্ত উদ্বাস্তু পরিবারগুলি পুনর্বাসনে আশায় দিন কাটাতে থাকে। নব গঠিত ভারত রাষ্ট্রের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের জনসংখ্যার ছিন্নমূল হওয়ার ঘটনা কোথাও দেখা যায়নি।  বলা হয় যে, দেশ ভাগের ফলে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার দ্বিগুন ও কানাডার জনসংখ্যার সমান জনগন উদ্বাস্তু হয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৯ লক্ষ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান২৫ লক্ষ মানুষ পূর্ব-পাকিস্তান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়। 

উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ

উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ নিইয়েছিল সেগুলি হল-

উদ্বাস্তু শিবির

নব গঠিত পাকিস্থান থেকে বাস্তুহারা হয়ে বহু মানুষ পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গের রেলস্টেশন, ফুটপাত, পরিত্যক্ত বাড়ি বা খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ভারত সরকার এই সমস্ত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম বাংলায় অসংখ্য অস্থায়ী শিবির তৈরি করেছিল। শিবির তৈরি করে ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের আপাতত থাকার জায়গা করে দেয়।

ত্রানের ব্যবস্থা

ভারত সরকার অস্থায়ী শিবিরগুলিতে উদ্বাস্তুদের খাদ্য, পানীয় জল, পোশাক পরিচ্ছদ, ঔষধ, নগদ অর্থ দেওয়া শুরু করে। শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তু পরিবারের বালক বালিকাদের শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা করা হয়।

নাগরিকত্ব প্রদান

ভারত সরকার নতিভুক্ত উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া শুরু করে। পাশাপাশি বিনামূল্যে খাদ্য দেওয়ার জন্য রেশন কার্ডও প্রদান করা হয়।

পুনর্বাসন 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু প্রথম থেকেই উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করেছিলেন। এই জন্য তিনি ব্যাপক উদ্যোগও নিয়েছিলেন। যে কারনে স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর ‘পুনর্বাসনের যুগ’ নামে পরিচিত।

এই পাঁচবছর ধরে উদ্বাস্তুদের জন্য স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার উদ্বাস্তুদের জমিদান, কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। শহরাঞ্চলের উদ্বাস্তুদের শিল্প ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিভিন্ন কল কারখানায় নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। পাশপাশি কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা হয়।

আন্তঃডোমেনিয়ন সম্মেল

স্বাধীনতার পর ভারত ও পাকিস্থানের বেশকিছু বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য Inter Dominion Conferences বা আন্তঃ ডোমেনিয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।

সরকার আশঙ্খা করেছিল ব্যাপক পরিমানে উদ্বাস্তুদের আগমন হিন্দু মুসলিমদের সম্পর্ককে খারাপ করবে। ফলত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে, দাঙ্গা রুখতে এবং উদ্বাস্তু স্রোত কমাতে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এই সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল।

দিল্লি চুক্তি

উদ্বাস্তু স্রোত কমাতে ১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি নামে খ্যাত।

দুই দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত করা হয়েছিল। এই চুক্তিতে স্থির হয়য় দুটি দেশের সংখ্যালঘু মানুষ নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে। দুটি রাষ্ট্রই নিজ নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেবে।

তবে কংগ্রেসের মন্ত্রীসভার মধ্যে থেকেই অনেকে এই চুক্তি মেনে নিতে পারেনি। আস্থা রাখতে না পেরে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে. সি. নিয়োগী নেহেরুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন ।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা

উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে কেন্দ্র সরকারের ন্যায় রাজ্য সরকারও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ব-পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে যে সব বাস্তুহারা হয়ে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন; তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিধান চন্দ্র রায় নানা পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন মন্ত্রীসভার সদস্য নলিনীরঞ্জন সরকার

কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের অগ্রাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ত্রান শিবির খোলা হয়েছিল। উদ্বাস্তুদের বাসস্থান  দানের জন্য নানা পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা। 

উপসংহার

উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ভারত সরকার একাধিক ভূমিকা পালন করেছিল। তৎসত্ত্বেও বলা চলে যে, সমস্যা সমাধানে দিল্লি ও পাঞ্জাবের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও, এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা অবহেলিত হয়েছিল। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু দিল্লি চুক্তির মাধ্যমে উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করলেও, এই সমস্যা কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বহাল ছিল। এই চুক্তির পরও বহু হিন্দু নির্যাতিত হয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছে। তাই বলা চলে, উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ভারত সরকার পুরোপুরি ভাবে সফল হয়নি। যে কারনে স্বাধীনতার পর বহু বছর কেটে গেলেও এখনও কিছুটা হলেও উদ্বাস্তু সমস্যা রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *