আঠারো শতকে আরব দেশে ইসলাম শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্যে আব্দুল ওয়াহাব যে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, তা ওয়াহাবী আন্দোলন নামে খ্যাত। বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলন আন্দোলনের সূত্রপাত করেন মির নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। তিনি মক্কায় হজে গিয়ে ওয়াহাবী নেতা সৈয়দ আহমেদের কাছ থেকে ওয়াহাবী আন্দোলনের আদর্শ গ্রহণ করেন এবং বাংলায় এসে ওয়াহাবী আন্দোলন শুরু করেন। ক্রমে এই আন্দোলন নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয়, যা ইতিহাসে বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
বারাসাত বিদ্রোহের কারণ
মির নিসার আলী ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নারকেলবেড়িয়ার কাছে চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি তিতুমীর নামে অধিক খ্যাত।
প্রথম জীবনে তিনি নদীয়ার জমিদারদের অধীনে লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করতেন। ফলে দরিদ্র কৃষকদের উপর জমিদারী শ্রেণীর অত্যাচারের স্বরূপ তিনি সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মক্কায় হজে যান এবং সেখানেই ওয়াহাবী নেতা সৈয়দ আহমেদের থেকে দীক্ষা গ্রহন করেন।
এরপর ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে জমিদারের লাঠিয়ালের চাকরি ছেড়ে দেন এবং ধর্মসংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
তিতুমীর দরিদ্র মুসলমান চাষী ও তাঁতিদের মধ্যে ওয়াহাবীর আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। মূলত গোবরডাঙ্গা–নারকেলবেড়িয়া অঞ্চল জুড়ে ধর্মসংস্কারের কাজে লেগে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকশো দরিদ্র মুসলমান তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহন করে।
ওয়াহাবীরা মূর্তিপূজা, পীরের পূজা এবং সুদের কারবার সহ বিভিন্ন কুসংস্কারের তীব্র বিরোধী ছিলেন। পোশাক ও সাজসজ্জার দিক থেকেও তারা অন্যান্য মুসলমানদের থেকে আলাদা ছিল। তারা মাথা কামাতো, দাড়ি রাখতো এবং বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরিধান করতো।
তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা মুসলমানদের ওয়াহাবী মতাদর্শে ধর্মান্তরিত করতে থাকে। কৃষ্ণদেব রায়ের জমিদারীতে পুঁড়া গ্রামে ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা প্রচুর ছিল।
ধীরে ধীরে ওয়াহাবীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবীদের কর্তৃত্ব খর্ব করতে ওয়াহাবীদের দাড়ির উপর আড়াই টাকা কর ধার্য করে। পার্শ্ববর্তী কুরগাছি ও নগরপুর অঞ্চলের জমিদাররাও ওয়াহাবীদের কর্তৃত্ব খর্ব করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেন। ওয়াহাবীদের উপর জরিমানা আরোপ করা হয়।
জমিদারের লোকেরা ওয়াহাবীদের কাছ থেকে বলপূর্বক জরিমানা আদায় করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মাঝে মধ্যে ওয়াহাবীদের দাড়িও উপড়ে নিত। দরিদ্র কৃষকরা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মনস্থ করে।
তিতুমীর অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাঁর অনুগামীদের নিয়ে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেন। বিদ্রোহীদের দমন করতে কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের গ্রাম আক্রমন করেন এবং একটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিতুমীর সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নেন এবং বারাসাত বিদ্রোহের সূত্রপাত করেন।
বারাসাত বিদ্রোহের ঘটনাবলী
তিতুমীর ৩০০ জন অনুগামী নিয়ে কৃষ্ণদেব রায়ের পুঁড়াগ্রাম আক্রমন করে এবং বিদ্রোহীরা বাজারের বেশ কিছু দোকানে লুণ্ঠন চালায়। এতে বহু হিন্দু মন্দিরও ধ্বংস করা হয় এবং বহু পুরোহিত নিহত হন।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বারাসাত অঞ্চলে ওয়াহাবী আন্দোলন পুরদমে শুরু হয়ে যায়। পুঁড়াগ্রামের পর বিদ্রোহীরা লাউঘাটা ও রামচন্দ্রপুর গ্রাম দুটি আক্রমন করেন। বিদ্রোহীরা ইছামতী নদীর তীরবর্তী একের পর এক নীলকুঠি ধ্বংস করে আগুন লাগিয়ে দেন।
তিতুমীর বারাসাত ও বসিরহাট অঞ্চল থেকে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজেকে বাদশাহ হিসাবে ঘোষণা করেন। মইনুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ভাগ্না গোলাম মাসুমকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশ দিয়ে কেল্লা নির্মাণ করে, যা ইতিহাসে বাঁশের কেল্লা নামে খ্যাত। এটিই তিতুমীর বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন চব্বিশ পরগণা, খুলনা, ঢাকা, যশোহর, মালদা, নদীয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই সমস্ত এলাকা থেকে তিতুমীর খাজনা আদায় শুরু করে।
বারাসাত বিদ্রোহের ফলাফল
বিদ্রোহের ব্যাপ্তি দেখে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা ব্রিটিশ সরকারের দ্বারস্থ হন।
স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী তিতুমীরের বিদ্রোহকে দমন করতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ বাহিনী দুই দুবার তিতুমীরের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।
অবশেষে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর ব্রিটিশ বাহিনী বাঁশের কেল্লা ঘিরে ফেলে। ১৪ই নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমির ও তাঁর অনুগামীদের উপর আক্রমন চালায়।
এই যুদ্ধে কামান ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশ বাহিনী। বিদ্রোহীরা কামানের বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশে বাহিনীর কামানের গোলায় বাঁশের কেল্লা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
এই রণক্ষেত্রে তিতুমির সহ কয়েকজন অনুগামী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ৮০০ জন অনুগামীকে বন্দি করা হয়। বিচারে অনুগামীদের দ্বীপান্তরে পাঠানো হয় এবং সেনাপতি গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ইংরজ বাহিনী বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলন দমন করে এবং তিতুমীরের মৃত্যুর সাথে সাথে বারাসাত বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
বারাসাত বিদ্রোহের প্রকৃতি
ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হওয়া ওয়াহাবী আন্দোলন ক্রমে সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয়। যাকে বারাসাত বিদ্রোহ বলা হয়। এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। মূলত পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে তিতুমীর বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল।
তাই হান্টার, থনটনের মতো ঐতিহাসিকরা একে জমিদার বিরোধী আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী এই বিদ্রোহকে জমিদার ও ইংরেজ সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম হিসাবে দেখেছেন।
উইলিয়াম হান্টার বারাসাত বিদ্রোহকে জমিদার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ হিসাবে দেখেছেন।
ডঃ বিনয়ভূষণ চৌধুরী বারাসাত বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন।
রণজিৎ গুহ বলেছেন, সরকারি দপ্তরের, নীলকুঠিরের এবং জমিদারের কাছারিবাড়ির নথি ধ্বংস করা ছিল এই বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিন্মবর্গের সাধারণ অংশ নিয়েছিল। তাই অধ্যাপক গুহ ওহায়াবী বিদ্রোহকে নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ইজ্জতরক্ষার লড়াই বলেছেন।
তবে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিহারীলাল সরকার, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে বারাসাত বিদ্রোহ ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আন্দোলন।
সমসাময়িক সমাচার চন্দ্রিকা এই বিদ্রোহকে মুসলমানের হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসাবে দেখিয়ে ছিল।
সাম্প্রতিক কালের কিছু গবেষকও এই বিদ্রোহের মধ্যে মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিপ্রসূত কার্যকলাপ খুঁজে পেয়েছেন। তিতুমিরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকার লিখেছেন যে প্রচুর দরিদ্র হিন্দু তিতুমিরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। আবার বহু মুসলিম ভূস্বামীও ওয়াহাবী বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হন।
সুতরাং এই বিদ্রোহ ধর্মকে কেন্দ্র করে আরম্ভ হলেও ক্রমেই তা সংকীর্ণ ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে দরিদ্র মানুষের জমিদার ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।
অন্যদিকে ডব্লু সি স্মিথ তাঁর ‘Modern Islam In India: A Social Analysts’ গ্রন্থে লিখেছেন, “এই বিদ্রোহ ধর্মীয় ছিল, তবে সাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন ছিল না।” তিনি আরও বলেছেন, কৃষক হিসাবে ওয়াহাবীদের শ্রেণীচেতনাই আন্দোলনের মূল গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করেছিল।
যাইহোক, সবশেষে বলা যায় ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হলেও, ক্রমে তা কৃষক বিদ্রোহের রূপ নেয়। দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হয়ে জমিদারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। তাই ওয়াহাবী আন্দোলন বা বারাসাত বিদ্রোহকে ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষক বিদ্রোহ বলা চলে।