বাংলার নবজাগরণ ও তার সীমাবদ্ধতা

রেনেসাঁ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি শব্দ Renaistre থেকে, যার অর্থ পুনর্জন্ম বা নবজাগরণ। পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের ইউরোপের ইতালিতে প্রথম রেনেসাঁস ঘটে। আঠারো শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব এসে পরে ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে।

বঙ্গীয় রেনেসাস

উনিশ শতক জুড়ে বাংলায় ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে চিন্তার যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়, ঐতিহাসিকরা তাকেই বঙ্গীয় রেনেসাঁস বা বাংলার নবজাগরণ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

বাংলার নবজাগরণ প্রথম শুরু হয় কলকাতাতে। তৎকালীন ভারতের রাজধানী হওয়ার কারনে বাঙালিরাই প্রথম ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করে। ফলে বাঙালিরা ইউরোপের আধুনিক চিন্তাধারা, জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। পশ্চিমের বিজ্ঞান চেতনা, যুক্তিবাদ, উদারনীতিবাদ, মানবতাবাদ প্রভৃতি নতুন ধ্যান ধারণা বাঙালির মনোজগতে এক অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। এই পরিবর্তনের ফলে বাংলায় নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে।

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণের নেতৃত্বে বাংলার ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজ ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয় এবং এক নবযুগের সূচনা ঘটে। ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাতে প্রথম নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে, ফলে সারা ভারতের মধ্যে বাংলা আধুনিক চিন্তা চেতনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারকবাহকে পরিণত হয়।

হেস্টিংস, ম্যালকম, মনরো প্রমুখের মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদারচেতা প্রশাসক বাংলায় আধুনিক ধারণা ও শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। খ্রিস্টান মিশনারীরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এক্ষেত্রে এশিয়াটিক সোসাইটি ও শ্রীরামপুর ব্যাপিস্ট মিশন নাম দুটি উল্লেখ্য। এ সময় কলকাতায় ছোট-বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাপাখান, গ্রন্থাগার গড়ে উঠতে শুরু করে। হিন্দু কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার  নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, মীর মোশারফ হোসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই বুদ্ধিদীপ্ত আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণ বলা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। একদল ঐতিহাসিক বাংলার নবজাগরণকে প্রকৃত নবজাগরণ বলে মেনে নিয়েছেন এবং একদল ঐতিহাসিক একে নবজাগরণ বলে গণ্য করেন না।

নবজাগরণের পক্ষে মতামত

রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশব চন্দ্র পাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ উনিশ শতকের বাংলার মানসিক স্ফুরন ও সংস্কারের আন্দোলনকে নবজাগরণ বলেছেন।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার প্রমূখ ঐতিহাসিক নবজাগরণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। উনিশ শতকে বাংলায় ‘রেনেসাঁস’ সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য রাখেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। তিনি উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁসকে ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় অবদান বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন এর ব্যাপ্তি ইউরোপীয়  রেনেসাঁসকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর ‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে ‘নবজাগরণের পীঠস্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা যায়, উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার থেকেও ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক।”

নবজাগরণের বিপক্ষে মতামত

অপর দিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁসকে অনেকে নবজাগরণ বলে মেনে নিতে রাজি নয়।

ডঃ সুমিত সরকার, অশোক মিত্র, সুপ্রকাশ রায়, বিনয় ঘোষের মতো ঐতিহাসিকেরা একে নবজাগরণ বলতে অস্বীকার করেছেন। অশোক মিত্র ১৯৫১ সালে আদমশুমারি বা Census তৈরির সময় বাংলায় উনিশ শতকের নবজাগরণকে “তথাকথিত নবজাগরণ” বলে অভিহিত করেছেন।

তাঁর বক্তব্য, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যে বিপুল পরিমান অর্থ লাভ করেছিল সরকার, তার একটি অংশ কলকাতার সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খরচ হয়েছিল। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ ছিল না।

ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর বাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থে একে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,”নবজাগরন হয়নি, যা লেখা হয়েছে এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা মাত্র।”

ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দার বাংলার নবজাগরণকে “এক অসত্য নিরস ঘটনা” বলে উল্লেখ করেছেন।

অন্যদিকে ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বাংলার নবজাগরণকে স্বীকার করে নিলেও, ইউরোপীয় নবজাগরণের সাথে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ইতালিতে নবজাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিল স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণী, অন্যদিকে বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছে এদেশীয় জমিদারদের হাত ধরে।

গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, “বাংলার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন ও বিপরীতমুখী”।

বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা

মূলত শহর কলকাতাকে কেন্দ্র করেই বাংলার নবজাগরণ ঘটেছিল। কলকাতার পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তবে গ্রাম বাংলার মানুষ নবজাগরণের কোনো সুফল ভোগ করেনি। কৃষক থেকে শুরু করে শ্রমিক শ্রেণী এই নবজাগরণে অংশ নেয়নি।

বাংলার নবজাগরণ মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে এই নবজাগরণ কাল ক্রমে হিন্দু জাগরণবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। যার নেতৃত্ব দিয়েছিল বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ। তাঁরা হিন্দু শাস্ত্র মতে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন। তাই বেশির ভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন এর বাইরে ছিল।

মূল্যায়ন

যাইহোক উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, সমগ্র বাংলার সমাজ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। নবজাগরণের ফলেই বহু বছর ধরে চলে আসা সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। বিধবা বিবাহ প্রচলন হয়। এছাড়া শিক্ষার হার বাড়ে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে, বাল্যবিবাহ বন্ধ হয় এবং কুসংস্কারের অন্তরজাল থেকে বেরিয়ে মানুষের এক নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *