হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

থানেশ্বরের রাজা প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুর পর তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।

কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যবর্ধনের অকাল মৃত্যুর পর রাজা প্রভাকর বর্ধনের কনিষ্ঠ পুত্র হর্ষবর্ধন পুষ্যভূতি বংশের উত্তর অধিকারী হিসাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। 

বানভট্টের হর্ষচরিত এবং চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং -এর বিবরণী থেকে জানা যায় হর্ষবর্ধন শুধুমাত্র একজন সাম্রাজ্য বিজেতা হিসাবে নয়, একজন প্রজাকল্যাণকামী শাসক হিসেবেও যথেষ্ট সফল ছিলেন।

তার শাসনব্যবস্থাকে ‘প্রজাহৈতেষী স্বৈরাচার‘ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।

প্রজাবৎশল শাসন ব্যবস্থা

হর্ষবর্ধন ছিলেন প্রজা হৈতেষী রাজা। শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি দিকেই তিনি সতর্ক দৃষ্টি আরোপ করতেন। তিনি ছিলেন শাসনব্যবস্থার মূল কেন্দ্র। হিউয়েন সাং -এর বিবৃতি অনুযায়ী জানা যায় দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি রাজকার্য পরিচালনায় অতিবাহিত করতেন।

প্রজাদের সঙ্গে গণসংযোগ রাখার জন্য এবং তাদের অভাব অভিযোগগুলি স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি নিয়মিত ছদ্মবেশ ধারণ করে সাম্রাজ্য পরিদর্শন করতেন ও রাজ্য পরিভ্রমণ কালে প্রজাদের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ব্যক্তিগত তদন্ত করতেন। 

মন্ত্রী পরিষদগন

হর্ষবর্ধন মন্ত্রী পরিষদের সাহায্য নিয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। এই মন্ত্রী পরিষদটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।

মন্ত্রী পরিষদের কাজ ছিল রাজাকে শাসন কার্যে সহায়তা , পররাষ্ট্রনীতি, বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণে সহায়তা ছাড়াও যুদ্ধ-বিদ্রোহ বা অন্য কোন সংকটজনক পরিস্থিতি ও বিপদের সময় রাজাকে পরামর্শ দেওয়া। 

রাজ্যবর্ধনের অকাল মৃত্যুর পর মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অনুরোধে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাজ কর্মচারীবৃন্দ

বিভিন্ন বিভাগে থাকা উচ্চপদস্থ কর্মচারী হর্ষবর্ধনকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সহায়তা করতেন।

কুমারমাত্য‘ রা ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রাজার কাছে এরা খুব কাছের এবং বিশ্বাসভাজন ছিলেন।

এছাড়াও অবন্তী– পররাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সিংহনাদ– প্রধান সেনাপতি, কুন্তল– অশ্ববাহিনীর প্রধান কর্মচারী, মহাসামন্ত, রাজস্থানীয় ও উপরিক বিষয়পতি প্রভৃতি রাজ কর্মচারীবৃন্দ রাজাকে নানাভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতে সহায়তা করতেন। 

সামরিক বিভাগ

হর্ষবর্ধন সামরিক বিভাগের সেনাবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, রথী ও হস্তি বাহিনী এই চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল।

সাধারণ সেনারা চটভট নামে পরিচিত ছিল এবং অশ্ববাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বৃহদশ্বর নামে পরিচিত ছিল।

পদাতিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বলাধিকৃতমহা বলাধিকৃত নামে পরিচিত ছিল। 

সামরিক বিভাগের প্রয়োজনীয় অশ্ব তিনি সিন্ধু, পারস্য ও কম্বোজ থেকে সংগ্রহ করতেন। 

প্রাদেশিক শাসন

মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের মতোই হর্ষবর্ধন তার সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশ, জেলা এবং গ্রাম ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রদেশগুলির নির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া যায় নি।

প্রদেশের প্রধান ছিলেন লোকপাল। প্রদেশ (ভুক্তি) গুলি একাধিক জেলায় (বিষয়) বিভক্ত ছিল।

জেলা বা বিষয়ে প্রধান ছিলেন বিষয়পতি

গ্রাম ছিল সর্বনিম্ন শাসন বিভাগ এবং গ্রামের শাসনভার ছিল গ্রামিক নামক কর্মচারীর হাতে।

রাজস্ব কর

হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে তিন প্রকারে কর প্রচলিত ছিল, যথা- ভাগ, হিরণ্যবলি

  • ভাগ– ছিল ভূমি রাজস্ব এবং শস্যের মাধ্যমে রাজস্ব দানের চল ছিল।
  • হিরণ্য– ছিল বাণিজ্য শুল্ক। 
  • বলি– ছিল জরুরি অবস্থায় অতিরিক্ত আদায় করা কর। 

উৎপন্ন শস্যের এক ষষ্ঠাংশ রাজকর রূপে ধার্য করা হতো। হিউয়েন সাং -এর মতে হর্ষবর্ধনের কর কথা ছিল উদার প্রকৃতির। 

আদায়কৃত রাজস্ব কর’কে চার ভাগে ভাগ করে ব্যয় করা হতো- 

  • প্রথম ভাগ রাজ্য শাসন ও পরিচালনায় নিয়োজিত হতো।
  • দ্বিতীয় ভাগ রাজ কর্মচারীদের ভরণপোষণে ব্যয় করা হতো।
  • তৃতীয় ভাগ গুণী ব্যক্তিদের ভরণপোষণে ব্যয় করা হতো।
  • চতুর্থ ভাগের আয় ধর্ম কর্ম বাবদ খরচ করা হতো।

বিচার ব্যবস্থা

হর্ষবর্ধনের আমলে বিচার ব্যবস্থা ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় থাকলেও দন্ডবিধি কঠোর ছিল। সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদন্ড, জরিমানা এবং গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে অঙ্গচ্ছেদ, নির্বাসন এমনকি প্রাণদণ্ডের মতো শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।

অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী নির্ণয়ের জন্য দৈব পরীক্ষা যেমন অগ্নি, জল, তুলা দণ্ড প্রভৃতির আশ্রয় নেওয়া হত। 

গুপ্ত যুগ অপেক্ষা হর্ষবর্ধনের আমলে ফৌজদারি আইন কঠোর হওয়া সত্ত্বেও গুপ্ত যুগের চেয়ে অপরাধের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।

উপসংহার 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন এবং বৃহৎ সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় হর্ষবর্ধনের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা
হর্ষবর্ধন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *