বিহারের ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল কোলেদের বাসভূমি। উপজাতি জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত কোলেরা হো, মুন্ডা, ওঁরাও বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভক্ত ছিল।
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছোটনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার চলে যাবার পর সহজ সরল স্বাধীনচেতা কোল জনজাতির মনে ভীতির সঞ্চার হয়।
এর ফলস্বরূপ ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ও জমিদার, মহাজন, জোতদারদের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোলেরা শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে যা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
সময় কাল | ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ |
বিদ্রোহের এলাকা | ছোটনাগপুর, রাঁচি, হাজারীবাগ, পালামৌ, সিংভূম |
নেতৃত্ব বৃন্দ | বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা, ঝিন্দরাই মানকি, সিংরাই মানকি |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
কোল বিদ্রোহের কারণ
কোল বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার কারণ গুলি হল-
১) নতুন ভূমি রাজস্ব নীতি:
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটনাগপুর অঞ্চল দখল করার পর সেখানে নতুন নতুন ভূমি রাজস্ব নীতি প্রয়োগ হতে থাকে। অঞ্চলটি কয়েকটি অংশে ভাগ করে কোম্পানি বহিরাগত জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের ইজারা দিয়ে দেয়।
২) রাজস্ব কর বৃদ্ধি:
বহিরাগত জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ীরা কোলদের উপর উচ্চহারে রাজস্ব কর আরোপ করে তাদের শোষণ করতে শুরু করে।
৩) অধিকার হরণ:
ছোটনাগপুর অরণ্যভূমি অঞ্চলে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে কোলেরা। অরণ্য ছিল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তন হবার পর কোলেরা তাদের চিরাচরিত অরণ্যের অধিকার হারায় এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের স্বাধীনচেতা জীবনে ছন্দপতন ঘটে।
৪) বহিরাগত অনুপ্রবেশ:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইজারাদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর কোল সম্প্রদায়ের জমিদার হিসেবে নিয়োগ করা হয় বহিরাগত মহাজন, জমিদার বা দিকুদের হাতে। এই দিকুরা উচ্চ হারে রাজস্ব কর আদায়ের পাশাপাশি কোলেদের নানা ভাবে শোষণ ও অত্যাচার করত। এর ফলস্বরূপ কোল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৫) শোষন ও অত্যাচার:
উচ্চহারে রাজস্ব কর অনাদায়ে কোলেদের নানাভাবে অত্যাচার করা হতো। তাদের নিজ নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। এমনকি শারীরিক নির্যাতন থেকে শুরু করে নারীদের সম্মানহানি কিছুই বাদ যেত না।
৬) প্রতারণা:
কোম্পানি নগদ অর্থে খাজনা প্রদানের নিয়ম চালু হবার পর কোলেরা মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নানাভাবে প্রতারিত হতে শুরু হয়। ফসল বিক্রি করতে গিয়ে দামে এবং ওজনে সহজ সরল কোলেদের প্রতারিত করাই ছিল ফসল ক্রেতাদের লক্ষ।
৭) ঐতিহ্য আঘাত:
ভারতের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী ও আদিবাসীদের নিজস্ব আইন-কানুন, ভূমি ব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি, জীবন যাপন প্রণালী, ঐতিহ্য ছিল। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর সেই চিরাচরিত ঐতিহ্যের অবসান ঘটে। কোল সম্প্রদায়ের উপরেও ইংরেজরা নিজেদের বলবৎ আইন কানুন, বিচার ব্যবস্থা, কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা আরোপ করা হলে কোলেদের জাতিগত ঐতিহ্য আঘাত লাগে।
এছাড়াও আরও অন্যান্য কারণ যেমন-
৮) চিরাচরিত কৃষিকাজ বন্ধ করে কোলেদের ইচ্ছা ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে আফিম চাষ করতে বাধ্য করা হতো।
৯) দেশি মদের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়।
১০) সরকারি রাস্তা ও গৃহ নির্মাণে কোলেদের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দান করতে হতো।
১১) কোল রমণী ও পুরুষদের উপর অহেতুক নির্যাতন এবং শারীরিক অত্যাচার করা হতো।
এইসব কারণে কোল উপজাতি জনগণ বাধ্য হয়ে বহিরাগত ইংরেজ ও দিকুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
বিদ্রোহের বিস্তার:
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছোটনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার চলে যায়। কোল সর্দাররা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেও এরপর থেকেই নানা কারণে কোল জনজাতির মনে ইংরেজ সরকার এবং বহিরাগত দিকুদের প্রতি ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কোল সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছোট ছোট বিদ্রোহ সংঘটিত করে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ছোটনাগপুর, রাঁচি, হাজারীবাগ, পালামৌ, সিংভূম প্রভৃতি অঞ্চলে কোল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিদ্রোহী কোলেদের সঙ্গে হো, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠী এবং সাধারণ চাষী, কামার, কুমোর, গোয়ালা প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষ যোগ দিলে এই বিদ্রোহ অন্য মাত্রা লাভ করে।
বিদ্রোহের নেতৃত্ববৃন্দ বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা, ঝিন্দরাই মানকি, সিংরাই মানকি প্রমুখেরা কোলেদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।
বিদ্রোহীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল বহিরাগত দিকু অর্থাৎ মহাজন, শস্য ব্যবসায়ী, লবনের কারবারি, ব্রিটিশ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলিমরা।
বিদ্রোহীরা সাফ জানিয়ে দেয় তাদের হয় ছোটনাগপুর ছাড়তে হবে নয়তো মৃত্যুবরণ করতে হবে।
বিদ্রোহীরা বহু জমিদার, জোতদার, মহাজন ব্যবসায়ী ও ইংরেজ কর্মচারীদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বহু লোককে হত্যা করে।
বিদ্রোহের অবসান:
কোল বিদ্রোহ ভয়ংকর আকার ধারণ করলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহ দমনে তৎপর হয়ে ওঠে।
ক্যাপ্টেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে, দমন নীতির মাধ্যমে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
ইংরেজ সেনাবাহিনীর হাতে হাজার হাজার আদিবাসী নির্মমভাবে প্রাণ হারান।
এরপর কোলেদের বিহার থেকে বিচ্ছিন্ন করে, বিদ্রোহ প্রবণ এলাকা গুলি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই ব্যবস্থা লাগু থাকে।
কোল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব:
ব্রিটিশ সরকার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা এই বিদ্রোহ দমন করলেও ভারতীয় আদিম জনজাতির বিদ্রোহ গুলির মধ্যে কোল বিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
মাতৃভূমি রক্ষায় কোলদের অসীম সাহসিকতা এবং লড়াই -এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথক ভূখণ্ড তৈরি:
এই বিদ্রোহের ফলেই কোল জনজাতিদের জন্য ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি (South West Frontier Agency (SWFA) নামক পৃথক নতুন এক ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় যার সদর দপ্তর ছিল লোহারদাগা, পরবর্তীকালে কিশুণপুরে (এখন রাঁচি) স্থানান্তরিত করা হয়।
স্বতন্ত্র নিয়ম:
কোল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে স্বতন্ত্র কিছু নিয়মকানুন প্রবর্তন করা হয়।
এছাড়াও-
- কোল প্রধানদের কেড়ে নেওয়া জমি জমিদারদের কাছ থেকে জমি ফেরত নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- জমি জরিপ করার ব্যবস্থা ও ভূমি বন্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
- জমি হস্তান্তরে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়
বিশ্লেষণ:
বিদ্রোহীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল বহিরাগত দিকু অর্থাৎ জমিদার, মহাজন, জোতদারেরা থাকলেও চার্লস মেটকাফ মনে করেন বিদ্রোহী কোলেদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো।
কোলেরা ছিল আদিম আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায় ভুক্ত। ছোটনাগপুর অঞ্চলে অরণ্যের অধিকার ক্ষুন্ন রাখতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
এই বিদ্রোহে কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন –
- সুযোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন নেতার অভাব।
- বিদ্রোহীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল সীমিত।
- শুধুমাত্র ছোটনাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ থাকায় তা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারেনি।
তা সত্ত্বেও সীমিত সামর্থ্য, সুযোগ-সুবিধা নিয়েই কোলেরা যেভাবে অন্যায়, অত্যাচার, শোষন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল তা অনস্বীকার্য।