অষ্টাদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ইজারাদারি ব্যবস্থা ও শোষন, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ ছিল রংপুর বিদ্রোহ ।
সময় কাল | ১৭৮৩ |
বিদ্রোহের এলাকা | রংপুরের কাজিয়াহাট, কাকিনা ফতেপুর ডিমলা এবং দিনাজপুর |
নেতৃত্ব বৃন্দ | নুরুলউদ্দিন |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
রংপুর বিদ্রোহ
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে দেবী সিংহ নামে এক জৈনিক ব্যক্তি তৎকালীন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছ থেকে দিনাজপুর, রংপুর সহ এদ্রাকপুর পরগনার (বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকার বিনিময়) ইজারা নিয়ে রাজস্ব আদায়ের অনুমতি লাভ করে।
কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও নিজের জমিদারি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সেখানকার প্রজাদের ওপর নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করার সাথে সাথে রাজস্ব কর বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
এই অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি সেখানকার প্রজা, কৃষক ও জমিদাদের উপর শোষন ও অত্যাচার করতে শুরু করলে রংপুরের কাজিরহাট, কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা ও দিনাজপুর, এদ্রাকপুরের কৃষকরাও দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতিহাসে এই বিদ্রোহকে রংপুর বিদ্রোহ বলে।
রংপুর বিদ্রোহের কারণ
এই বিদ্রোহের কারণ গুলি হল-
১) দেবী সিং -এর অত্যাচার:
কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও নিজের জমিদারি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে দিনাজপুর, রংপুর, এদ্রাকপুর কৃষকদের উপর নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করার সাথে সাথে রাজস্ব কর বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
এই অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে সেখানকার প্রজা, কৃষক ও জমিদাদের উপর শোষন ও অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেড়ে থাকে যে শেষ পর্যন্ত নিপীড়িত কৃষকেরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
২) অতিরিক্ত খাজনা বৃদ্ধি:
কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে বারো মাসের পরিবর্তে সতেরো মাসের খাজনা আদায় করা হতো। নিষ্কর জমিগুলিও সমস্ত বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এই এই ঋণের বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেতে কৃষকেরা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হত। গরু, বাছুর, সম্পত্তি এমনকি নিজের সন্তান বিক্রি করেও দেবী সিংহের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যেত না।
৩) অত্যাচার ও শারীরিক নির্যাতন:
রাজস্ব আদায় না হলে কৃষকদের উপর নিদারুণ শারীরিক অত্যাচার করা হতো। তাদেরকে ঘরবাড়ি ও জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের সম্পত্তি ও জমিজমা দখল করা হতো।
বিদ্রোহের সূত্রপাত ও বিস্তার
দেবী সিংহের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি রংপুরের কাজিয়াহাট, কাকিনা ফতেপুর ডিমলা এবং দিনাজপুরের কৃষকেরা তেপা গ্রামে মিলিত হয়ে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
তারা স্থানীয় নুরুলউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে নবাব ঘোষণা করে এবং খাজনা দেওয়া বন্ধ করার কথা জানায়।
ধীরে ধীরে গোটা উত্তরবঙ্গে এই প্রবণতা সংক্রামিত হলে বিদ্রোহ প্রবল রূপ ধারণ করে।
- দেবী সিংহ তৎকালীন রংপুরের কালেক্টর ম্যাকডোনাল্ডের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালে মোগলহাট ও পাটগ্রামের যুদ্ধে ম্যাকডোনাল্ডের ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে বিদ্রোহীরা পরাজিত হন।
ফলাফল ও গুরুত্ব
রংপুর কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম
১) এই বিদ্রোহের পর দেবী সিংহকে শেষ পর্যন্ত তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
২) দেবী সিংহকে পদচ্যুত করা হলে তার ভয়ংকর শোষণ অত্যাচার থেকে কৃষকেরা মুক্তি পান।
৩) এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ঐক্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছিল তার গুরুত্ব অপরিসীম।
৪) লর্ড কর্নওয়ালিস রাজস্ব আদায়ের এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ইজারাদারি ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।
৫) দেবী সিংহকে ইজারাদার পদ থেকে অপসারণ করা হলেও ওয়ারেন হেস্টিংস খুশি হয়ে তাকে রাজা উপাধিতে সম্মানিত করেন।
উপসংহার
কোম্পানি ও ইজারাদারি শোষণের বিরুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহ একটি গণ আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।
