ডারউইনবাদ বা ডারউইনিজম
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ করা কালীন এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন। এরপর তিনি 1859 খ্রিস্টাব্দে “প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রজাতির উদ্ভব” বা On The Origin of Species by Means of Natural Selection নামক গ্রন্থে তার বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তি সম্পর্কিত মতবাদ প্রকাশ করেন।
ডারউইনের অভিব্যক্তি সম্পর্কিত যে মতবাদ প্রকাশ করেন তা ডারউইনবাদ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ডারউইনিজম নামে পরিচিত।
ডারউইনের মতবাদের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি
ডারউইনের মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গুলি হল-
i) অত্যধিক জন্মহার
ডারউইনের মতে জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করা। এর ফলে জীবের সংখ্যা জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ:
একটি স্ত্রী স্যালমান মাছ প্রজননের ঋতুতে প্রায় তিন কোটি ডিম পাড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ডিমই নষ্ট হয়ে যায়। আবার হাতি 12 বছর অন্তর কেবল একটি সন্তানের জন্ম দেয়। অর্থাৎ, স্যালমান মাছের তুলনায় হাতি খুবই কম বাচ্চার জন্ম দেয়। ডারউইনের মতে, হাতির জন্ম দেওয়া সকল সন্তান যদি বেঁচে থাকে তবে 750 বছরে হাতির সংখ্যা 91 লক্ষ হবে। কিন্তু খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে সকল অপত্য বেঁচে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, জীবের যে কোন হারে জন্ম হলেও সকল অপত্য জীব বাঁচে না।
ii) খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা
ভূপৃষ্ঠের আকার ও আয়তন সীমিত। আত্যধিক হারে জীবের বংশবৃদ্ধির ফলে জীবের বাসস্থান ও খাদ্যের অভাব দেখা যায়। ফলস্বরূপ জীবের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় অর্থাৎ তারা প্রাকৃতিক বাধার সম্মুখীন হয়
iii) অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম
জীব আত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় প্রতিটি জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রামকে বিজ্ঞানী চার্জ ডারউইন- অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেন। ডারউইন লক্ষ্য করেন জীবকে তিন রকমের সংগ্রাম করতে হয়। যথা-
a) অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম
একই প্রজাতির সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে খাদ্য ও বাসস্থানের উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু করে। একে অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম বলে।
উদাহরণ:
শিকারের জন্য বাঘেদের মধ্যে লড়াই, খাবার ও আশ্রয়ের সন্ধানে কুকুরের মধ্যে লড়াই। কোন এক দ্বীপে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে খাদ্যের উদ্দেশ্যে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ইত্যাদি।
b) আন্তঃ প্রজাতি সংগ্রাম
দুই বা অধিক প্রজাতির সদস্যের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য যে প্রতিযোগিতা ঘটে তাকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম বলে।
উদাহরণ:
ব্যাঙ কীটপতঙ্গ খায় কিন্তু সাপ আবার ব্যাঙকে খায়। অন্যদিকে ময়ূর আবার ব্যাঙ ও সাপ উভয়কেই খায়।
c) পরিবেশগত সংগ্রাম
জীবকে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ যেমন খরা বন্যা ঝড় ভূমিকম্প ইত্যাদির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। এর ফলে জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ডারউইন তাদের এই সংগ্রামকে পরিবেশগত সংগ্রাম বলেছেন।
উদাহরণ:
প্রচন্ড তুষারপাতের কারণে উত্তর ও মধ্য আমেরিকার কোয়েল পাখি প্রচন্ড ঠান্ডা না সহন করতে পেরে পৃথিবী থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।
iv) প্রকরণ বা ভেদ
ডারউইনের মতে কোন একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির অন্তর্গত দুটো জীব কখনোই সম্পূর্ণ একই রকম হতে পারে না। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য দেখা যায়, যাকে প্রকরণ বা ভেদ বলে।
তিনি মনে করেন, কোন জীব তার জীবন দশায় অবিরত সংগ্রাম করার ফলে বিভিন্ন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে যা প্রজননকালে অপত্যের দেহে সঞ্চারিত হয়। এই প্রকরণগুলি ধারাবাহিকভাবে একত্রিত হয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অপত্য অথবা নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে। জীবদেহে কোন বৈশিষ্ট্যের হঠাৎ পরিবর্তনকে ডারউইন ‘প্রকৃতির খেলা‘ বলে এড়িয়ে গেছেন।
v) প্রাকৃতিক নির্বাচন
ডারউইনের মতে অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীব অন্যান্য জীবের সাথে প্রতিযোগিতায় বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। ফলে এরা বেশি সংখ্যায় বংশবিস্তার করে এবং বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকে। অনুকূল প্রকরণযুক্ত জীবেরা প্রকৃতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।
অপরদিকে, প্রতিকূল প্রকরণযুক্ত জীবেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
vi) যোগ্যতমের উদবর্তন
ডারউইনের মতে, অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে যোগ্যতম রূপে নির্বাচিত হয়। একে যোগ্যতম নির্বাচন বলে। এরা পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত অভিযোজিত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে।
অপরদিকে, প্রতিকূল প্রকরণযুক্ত জীবেরা জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে অবশেষে লুপ্ত হয়ে যায়।
vii) নতুন প্রজাতির সৃষ্টি
অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হওয়ায় এরা অন্যদের তুলনায় বেশি মাত্রায় বংশবিস্তার করে। পরবর্তী প্রজন্মেও প্রকরণগুলি সঞ্চারিত হয়। পরবর্তীতে অধিক অনুকূল প্রকরণসম্পন্ন অপত্য জীবের প্রকৃত দ্বারা নির্বাচিত হয়।
ক্রমাগত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় কিছু জনু পর একই প্রজাতির পূর্বপুরুষ এবং উত্তরাধিকারের মধ্যে বিপুল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উত্তর পুরুষদের নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এভাবেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি ঘটে।
উদাহরণ:
ডারউইনের মতে, জিরাফের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের গলা ছিল। কিন্তু উঁচু গাছের ডালের পাতা খাওয়ার জন্য প্রকৃতি লম্বা গলাযুক্ত জিরাফদের নির্বাচন করে। পরবর্তীতে লম্বা গলা যুক্ত জিরাফের অনুকূল প্রকরণগুলি তাদের উত্তরাধিকাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ফলে লম্বা গলাযুক্ত জিরাফ পৃথিবীতে টিকে থাকে এবং খাটো গলাযুক্ত জিরাফ ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়।
ডারউইনবাদের ত্রুটি
ডারউইনের মতবাদ জৈব অভিব্যক্তি ও বিবর্তনের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তুলে ধরলেও এর কিছু ত্রুটি ছিল। যেগুলি হল
1) ডারউইন মিউটেশন বা প্রকরণ সৃষ্টির কারণকে প্রকৃতির খেলা বলে এড়িয়ে গেছেন।
2) নিষ্ক্রিয় অঙ্গের উপস্থিতির কারণ তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।
3) দেহ কোষ ও জনন কোষের মধ্যে ঘটা প্রকরণগুলির মধ্যে তিনি পার্থক্য করতে পারেন নি।
4) তিনি ছোট, অস্থায়ী, ধারাবাহিক পরিবর্তন গুলির উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যা জীবের বিবর্তনে বিশেষ কোন ভূমিকা পালন করে না।
5) তিনি যোগ্যতম উদবর্তন কিভাবে ঘটে তা নিয়ে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি।
6) মেন্ডেলের সূত্র আবিষ্কার হওয়ার পর ডারউইনের মিশ্র বংশগতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়।
7) জলজ প্রাণী কিভাবে পরবর্তীকালে স্থলজ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে সেই বিষয়েও ডারউইন কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।