পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা

ব্রিটিশ শাসনের সূচনা কালে ব্রিটিশ শাসকরা এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। তবে উনিশ শতকের শুরু থেকে এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রসার লাভ করতে শুরু করে।

বাংলায় তথা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার এবং স্যার এডওয়ার্ড হাউড ইস্ট প্রমুখের নাম উঠে আসে।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় বিদেশীদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডেভিড হেয়ার। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

ডেভিড হেয়ার ছিলেন একজন স্কটিশ ঘড়ি নির্মাতা এবং জনদরদী মানুষ। তিনি হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডেভিড হেয়ার উনিশ শতকের ভারতে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৮১৭ সালে হেয়ার প্রতিষ্ঠিত হিন্দু স্কুল পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর হয় এবং এই কলেজ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ধারণার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ডেভিড হেয়ারের জন্ম ও কলকাতা আগমন

১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহন করেন ডেভিড হেয়ার। এরপর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা তথা ভারতে আসেন। এখানে এসে তিনি ঘড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ওপনিবেশিক শাসন কালে এ দেশের মানুষদের দুরাবস্থা দেখে তিনি তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। নিজের অর্থ ব্যয় করে এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের প্রতি বিশেষ উদ্যোগ নেয়।   

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ডেভিড হেয়ারের অবদান

ডেভিড হেয়ার ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়ে তাদের অবস্থার উন্নতি করতে চেয়েছিলেন। যে কারণে শেষ পর্যন্ত এ দেশেই থেকে গিয়েছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশীয় মানুষের কল্যাণের ভাবনা ভেবে গিয়ছেন।

১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে হেয়ারের সঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভা’র সঙ্গে যুক্ত হন এবং শিক্ষার উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা করতে থাকেন।

১) হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা

ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে ডেভিট হেয়ার যে সব উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

তিনি ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ই জানুয়ারি কলকাতায় হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন

এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলে কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট এবং  বৈদ্যনাথ মুখার্জি। বর্তমানে যা  প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। তিনি নিজ সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশ হিন্দু স্কুলে দান করেছিলেন।

২) ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি এবং ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি

শুধু ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেই তো হবে না, তার জন্য দরকার ইংরেজি ভাষার পুস্তক ও পাঠ্যক্রম। এই উদ্দেশ্যে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই কলকাতায় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপন করা হয়। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা, প্রকাশনা ও বিতরণের উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়। এই সোসাইটির উদ্যোগে গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের কম খরচে বা বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করা হতো।

তবে পুস্তক রচনার পাশাপাশি স্কুলের সংস্কার ও দ্রুত উন্নতির জন্য ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি গড়ে তোলা হয়। আদৰ্শ মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। কলকাতার স্কুলগুলির উন্নতি করা এবং নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এই সোসাইটি চালু করা হয়। এই সোসাইটির প্রয়াসে তৈরি করা হয় শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন এবং বিশপস কলেজ।

৩) হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠা

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি এবং হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠার পর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর ডেভিড হেয়ার ‘পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি’ নামক আরও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে হিন্দু কলেজের বিপরীতে এই নতুন স্কুল খোলা হয়। বর্তমানে এটি হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত।

৪) মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং নারী শিক্ষা

ডেভিড হেয়ার নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অংশ নিয়েছিল। ১৮৩৫ সালে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি এই কলেজের সম্পাদক পদেও নিযুক্ত ছিলেন।

এছাড়াও বাংলায় নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও হেয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাংলায় বেশ কয়েকটি মহিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নারী শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।

উপসংহার

বাংলা তথা ভারতে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে ডেভিড হেয়ারের অসামান্য অবদান কখনোই ভোলার নয়। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে কলকাতাবাসী ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে হেয়ার স্কুলের প্রাঙ্গনে ডেভিড হেয়ারের স্ট্যাচু নির্মাণ করে। তাঁর নাম স্মরণে রাখতে স্কুল ও রাস্তার নাম তাঁর নামে রাখা হয়, যথা হেয়ার স্কুল এবং হেয়ার স্ট্রিট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *