ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই ভূমিকম্প ভূমিরূপ এবং মানব জীবনে প্রভাব ফেলে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে কোন অঞ্চলে ভূমিকম্প ঘটেছে তার উপর। অর্থাৎ জনবহুল এলাকায় ভূমিকম্পের তীব্রতা কম হলেও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে আবার জনবসতি অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা বেশি হলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।
ভূমিকম্পের ফলাফল বা প্রভাবকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) ভূতত্ত্বীয় পরিবর্তন
খ) মানবীয় ক্ষয়ক্ষতি
ক) ভূতত্ত্বীয় পরিবর্তন
ভূমিকম্পের প্রভাবে নিম্নরুপ ভূতত্ত্বীয় পরিবর্তন ঘটতে পারে
১) ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি
ভূমিকম্পের প্রভাবে শিলাস্তরের যে সমস্থৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় তার প্রভাবে ফাটল বা চ্যুতির সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূত্বকের কোন অংশ উঠে যেতে পারে আবার কোন অংশ নীচে বসে যেতে পারে বা শিলাস্তরে ফাটল দেখা দিতে পারে।
যেমন– ১৯২০ সালের ভূমিকম্পে চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিচে বসে গিয়েছিল।
২) গ্রস্ত উপত্যাকা এবং স্তুপ পর্বত
ভূমিকম্পের প্রভাবে ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি হয়। ফাটলের বা চ্যুতির মধ্যবর্তী ভূ-ভাগ, নিচের দিকে নেমে গিয়ে গ্রস্ত উপত্যকা আবার কখনও উপরের দিকে উঠে গিয়ে স্তুপ পর্বত গঠিত হয়।
যেমন– নর্মদা, তাপ্তি গ্রস্ত উপত্যকা, বিন্ধ্য ও সাতপুরা স্তুপ পর্বত এইরূপ সৃষ্টি হয়েছে।
৩) ধ্বস
ভূমিকম্পের প্রভাবে পার্বত্য অঞ্চলে ধসের সৃষ্টি হয় এর ফলে পার্বত্য উপত্যকায় ক্ষয়ক্ষতি ঘটে।
যেমন– ১৮৯৭ সালে আসামের ভূমিকম্পে এরকম বহু ধ্বস ঘটে।
৪) ভঙ্গিল পর্বত গঠন
ভূত্বকের গতিশীল দুটি পাত যখন পরস্পরের কাছে চলে আসে তখন ওই দুটি পাতের সংযোগ রেখা বরাবর শিলাচ্যুতি ঘটে এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে পাললিক শিলা স্তরে ভাঁজ পড়ে এবং ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়।
৫) নদীর গতিপথ পরিবর্তন
ভূমিকম্পের প্রভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে এমনকি নদী শুকিয়েও যেতে পারে।
যেমন– ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্পে দিবং নদী গতি পরিবর্তন করে নতুন খাতে বইতে শুরু করেছিল।
৬) জলাভূমি ও হ্রদ সৃষ্টি
ভূমিকম্পের প্রভাবে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে হ্রদ সৃষ্টি হয়। আবার সমুদ্র নদী বা হ্রদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বসে গিয়ে জলাভূমি সৃষ্টি করতে পারে।
যেমন– ১৮১৯ সালে কচ্ছের রান অঞ্চল বসে গিয়ে জলাভূমির সৃষ্টি করেছে।
৭) অগ্নুৎপাত
ভূমিকম্পের ফলে আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ খুলে গিয়ে অগ্নুৎপাত হতে পারে। আবার চ্যুতিরেখা বা ফাটল দিয়ে ভূ অভ্যন্তরের গলিত লাভা, গরম বাষ্প, গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে।
যেমন– ১৯৩৪ সালের বিহারের ভূমিকম্পে ফাটল দিয়ে গরম জল বেরিয়ে এসেছিল।
৮) সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস
ভূমিকম্পের প্রভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট এর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস কে সুনামি বলে।
যেমন– ২০০৪ সালে সুভদ্রা দ্বীপের ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে প্রায় তিন লক্ষ লোকের প্রাণহানি হয়।
৯) হিমানী সম্প্রপাত
ভূমিকম্পের ফলে হিমানি সম্প্রপাত হয় অর্থাৎ উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জমে থাকা বরফ ধ্বসের আকারে খসে পড়ে।
যেমন– পেরুতে ১৯৭০ সালে ভূমিকম্পের ফলে হুয়াস্কারান পর্বতে হিমানী সম্প্রপাত ঘটেছিল।
১০) ভৌম জল প্রবাহ
ভূমিকম্পের দরুন ভৌম জল প্রবাহ ও জল নির্মাণ প্রণালী বিঘ্নিত হয়। এর প্রভাবে কোন কোন স্থানে প্রস্রবণ বন্ধ হয়ে যায় আবার কোন কোন স্থানে নতুন প্রস্রবণে সৃষ্টি হয়।
খ) মানবীয় ক্ষয়ক্ষতি
ভূমিকম্প মানব জীবনের উপর প্রবল প্রভাব ঘটাতে পারে।
১) শহর ও নগর জীবনে প্রভাব
ভূমিকম্পের ফলে শহর ও জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি সবথেকে বেশি হয়ে থাকে। প্রবল ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি ভেঙে গিয়ে বহু মানুষে প্রাণহানি ঘটে থাকে।
এছাড়াও জল, বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যাঘাত ঘটে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।
যেমন– ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ৫২ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এবং প্রায় ৩৪.২ ডলারের মত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
২) জীবন ও সম্পত্তি হানি
ভূমিকম্পের দরুন বহু মানুষের সাথে গাদাবি পশু, চিড়িয়াখানার পশুদের প্রাণহানি ঘটে।
৩) বন্যা
ভূমিকম্পের ফলে নদী বা হ্রদের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।
৪) কৃষিকাজের ক্ষতি
ভূমিকম্পের ফলে কৃষি কাজ ব্যাহত হয়।
৫) অগ্নিকাণ্ড
তীব্র ভূমিকম্পে ঘর, বাড়ি কারখানায় বা বড় বড় বিল্ডিং এ আগুন ধরে যেতে পারে। এর প্রভাবে বিপুল সম্পত্তির ক্ষতি হতে পারে।