সুন্দরবনের পরিবেশগত সমস্যা

সুন্দরবন হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মুখে অবস্থিত লবণাম্বু উদ্ভিদের অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এটি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল (জাতীয় উদ্যান)।

সুন্দরবনে শুধুমাত্র ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ (সুন্দরী, গরান, গেওয়া) যে পাওয়া যায় তা নয় তার সঙ্গে বৈচিত্র্যময় জীবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যাদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, হরিণ, গো সাপ ইত্যাদি।

সুতরাং জীব বৈচিত্র্যের দিক থেকে দেখতে গেলে সুন্দরবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চলে বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই সমস্যাগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১) নগরায়নের জন্য লবণাম্বু উদ্ভিদের ধ্বংস

ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তার দরুণ অত্যাধিক বসতি স্থাপনের কারণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অরণ্য ধ্বংসের কারণ গুলি হল-

ক. গৃহ নির্মাণ

সুন্দরবনের প্রায় বেশিরভাগ গাছ হল লবণাম্বু উদ্ভিদ। এগুলি লবণাত্মক মৃত্তিকা ব্যতীত জন্মায় না ফলে সাধারণত এদের অন্য কোথাও জন্মাতে দেখতে পাওয়া যায় না। যেহেতু সুন্দরবনের অধিবাসীরা গৃহ নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণ লবণাম্বু উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করে, তাই যথেষ্ট ভাবে বন ধ্বংস হয়।

খ. আসবাবপত্র তৈরি

শুধুমাত্র গৃহ নির্মাণ নয় আসবাবপত্র তৈরিতেও লাবণাম্বু উদ্ভিদ ব্যবহার করা হচ্ছে। সুন্দরী গাছের কাঠ উচ্চ গুনমানের হওয়ায় আসবাবপত্র ভালো হয়। ফলে সুন্দরী গাছ বেশি পরিমাণে কাটা হচ্ছে এবং এদের সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকছে।

গ. জ্বালানি

সুন্দরবন এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা জ্বালানির প্রয়োজনেও বনাঞ্চল ধ্বংস করছে।

ঘ. পর্যটন শিল্প

পর্যটন ব্যবসার কারণে হোটেল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট ভাবে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ কাটা হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনের আয়তন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

২) কৃষি সংকট

সুন্দরবন অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরাই কৃষির ওপর নির্ভরকরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই অঞ্চলে কৃষির সংকট দেখা দিয়েছে।

ভূমিক্ষয়ের জন্য নদীর গভীরতা এবং পলি জমে খাঁড়িগুলির গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের নোনা জল চাষের জমিকে প্লাবিত করে চাষের এবং ফসলের ক্ষতি করে।

এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নদীবাঁধ ভেঙেও সমুদ্রের লবণাক্তক জল চাষের জমিতে প্রবেশ করে।

অনেক সময় পলিজমে কৃষি জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়।

৩) মিষ্টি জলের সংকট

সুন্দরবন সমুদ্র তীরবর্তী হলেও এই অঞ্চলে মিষ্টি জল অর্থাৎ স্বাদু জলের অভাব অত্যন্ত প্রকট। গঙ্গা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সুন্দরবনের অনেক নদী আজ গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে খাঁড়ি ও মোহনা অঞ্চলে মিষ্টি জলের সংকট সৃষ্টি করেছে।

এছাড়াও বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা এবং বন্যার কারণেও সুন্দরবনে মিষ্টি জলের সংকট দেখা দেয়।

সুন্দরবনে মিষ্টি জলের সংকটের ফল-

  • . মিষ্টি জলে বসবাসকারী বিভিন্ন মাছ ও প্রাণীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে।
  • . মিষ্টি জলের অভাবে উদ্ভিদেরা তাদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয়কলাপ পরিচালনা করতে পারে না ফলে এই অঞ্চলের গাছেদের ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরী গাছ কম লবণাক্তযুক্ত স্থানে ভালো জন্মায় কিন্তু মিষ্টি জলের অভাবে এদের সংখ্যাও ক্রমাগত কমছে।
  • . পানীয় জলের অভাবে বাঘ এবং হরিণের মতো প্রাণীরা বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

৪) বাসস্থান ধ্বংস

সুন্দরবনে প্রচুর সংখ্যায় ম্যানগ্রোভ সহ অন্যান্য গাছ কাটার ফলে বহু প্রাণীপ্রজাতি তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে। যার কারণে বন্যপ্রাণীগুলি বিশেষ করে সুন্দরবনের বাঘ বাসস্থানের অভাবে বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ছে এবং মানুষের সঙ্গে সংঘাতে অনেক প্রাণী মারা যাচ্ছে। বাসস্থানের অভাবে হরিণের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

গাছের শিকড় মাটি আঁকড়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলে ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে, জোয়ার ভাটা ও বন্যার কারণেও ভূমিক্ষয় হয়। ফলে সার্বিকভাবে সুন্দরবন এলাকায় বাসস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে।

৫) খাদ্য খাদকের সংখ্যার ভারসাম্যে ব্যাঘাত

বনভূমি হ্রাসের ফলে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে যেমন হরিণ ও বন্য শুকরের সংখ্যা কমছে, তেমনি বাঘেরও (শুকর ও হরিণকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে) খাদ্যাভাব ঘটছে। ফলে সুন্দরবনের বাঘ সরাসরি মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে।

৬) দূষণ

সুন্দরবন অঞ্চলের পরিবেশগত সমস্যার অন্যতম কারণ হলো দূষণ। কলকাতা ও হলদিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত শিল্পজাত দূষিত বজ্রপদার্থ গুলি নদীবাহিত হয়ে দূষণ ঘটায়। জলদূষণের কারণে নদীতে থাকা বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃত্যু ঘটছে।

বায়ু দূষণের ফলে সুন্দরী গাছগুলি এক ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

৭) সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং দ্বীপভূমির নিমজ্জন

বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ অন্যান্য নিচু উপকূল এলাকার মত সুন্দরবনের অনেক ছোট ছোট দ্বীপ জলে নিমজ্জিত হচ্ছে। এর ফলে ওই স্থানের বাস্তুতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হচ্ছে।

৮) জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস

সুন্দরবন এলাকায় মাছ সংগ্রহের সময় প্রচুর সংখ্যায় লবণাম্বু উদ্ভিদের চারা গাছ নষ্ট হচ্ছে। জাল টানার পর অন্যান্য প্রাণীর লার্ভা ও জলজ পোকামাকড় শুকনো জায়গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জীব বৈচিত্রের হ্রাস ঘটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *