জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের সাদৃশ্য জনিত প্রমাণ

মেরুদন্ডী প্রাণীদের দেহে রক্ত সংবহনের প্রধান অঙ্গ হলো হৃদপিণ্ড। মাছ থেকে শুরু করে স্তন্যপায়ী পর্যন্ত সমস্ত শ্রেণীর প্রাণীর দেহে হৃদপিণ্ড থাকে।

বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীতে হৃৎপিণ্ডের গঠন প্রকৃতি আলাদা হলেও মূল কাঠামো একই প্রকারে হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই হৃদপিন্ডে রক্ত গ্রহণকারী প্রকোষ্ঠ (অলিন্দ) এবং রক্ত প্রেরণকারী প্রকোষ্ঠ (নিলয়) থাকে যা সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে রক্তকে সারাদেহে সঞ্চালিত করে। সমস্ত দেহ থেকে রক্ত অলিন্দে গৃহীত হয় অপরদিকে নিলয় থেকে রক্ত দেহের সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

মেরুদন্ডী প্রাণীদের অর্থাৎ মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী এবং স্তন্যপায়ীর হৃদপিন্ডের মৌলিক গঠনের পর্যালোচনা করলে জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এরা একই উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

মাছের হৃদপিণ্ড

মাছের হৃদপিণ্ড গঠনগতভাবে সব থেকে সরল প্রকৃতির। এটি দুটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত, একটি অনিন্দ এবং একটি নিলয়। মাছের হৃদপিন্ডের মধ্য দিয়ে সর্বদা দূষিত রক্ত অর্থাৎ Co2 যুক্ত রক্ত প্রবাহিত হয় এবং একমুখী ভাবে প্রবাহিত হয়। এই প্রকার হৃদপিণ্ড একচক্রি এবং ভেনাস হৃদপিণ্ড নামে পরিচিত।

মাছের হৃদপিণ্ড চিত্র - জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের সাদৃশ্য জনিত প্রমাণ
মাছের হৃদপিণ্ড

উভচরের হৃদপিণ্ড

উভচরে হৃদপিণ্ড তিনটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত, দুটি অলিন্দ এবং একটি নিলয়, যা মাছের হৃদপিণ্ড এর তুলনায় কিছুটা উন্নত মানের। ডান অলিন্দে দূষিত রক্ত গৃহীত হয় এবং তা নিলয়ে প্রবেশ করে। এই রক্ত মহাধমনী ও ফুসফুসীয় ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে সংবাইিত হয়। আবার ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ (অক্সিজেনযুক্ত) রক্ত বাম অলিন্দ হয়ে পুনরায় নিলয় প্রবেশ করে। ফলে নিলয়ে দূষিত (অধিক Co2 যুক্ত)এবং বিশুদ্ধ (অধিক O2 যুক্ত) রক্তের মিশ্রণ ঘটে। বিশুদ্ধ রক্ত মহাধমনী এবং সিস্টেমিক আর্চ এর মাধ্যমে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই প্রকার হৃদপিন্ডাকে দ্বিচক্রী হৃদপিণ্ড বলে।

উভচরদের হৃদপিণ্ড চিত্র - জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের সাদৃশ্য জনিত প্রমাণ
উভচরদের হৃদপিণ্ড

সরীসৃপের হৃদপিণ্ড

সরীসৃপের হৃদপিণ্ড উভচরের তুলনায় উন্নত মানের। এদের হৃদপিণ্ড অসম্পূর্ণভাবে চারটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত, দুটি অলিন্দ ( ডান ও বাম অলিন্দ) এবং একটি অর্ধ বিভক্ত নিলয়। নিলয়ে অসম্পূর্ণ প্রাচীর থাকায় দূষিত এবং বিশুদ্ধ রক্তের সংমিশ্রণে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এখানে মহাধমনী তিনটি ভাগে বিভক্ত (একটি পালমোনারি আর্চ এবং দুটি সিস্টেমিক আর্চ) এবং হৃদপিণ্ডটি দ্বিচক্রী।

সরীসৃপদের মধ্যে শুধুমাত্র কুমিরের দেহে সম্পূর্ণরূপে চার প্রকোষ্ঠ যুক্ত হৃৎপিণ্ড দেখতে পাওয়া যায়।

সরীসৃপের হৃদপিণ্ডের চিত্র - প্রাণীদের অভিব্যক্তির সপক্ষে মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের সাদৃশ্য জনিত প্রমাণ
সরীসৃপের হৃদপিণ্ড

পক্ষী ও স্তন্যপায়ীর হৃদপিণ্ড

পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর হৃৎপিণ্ড সম্পূর্ণরূপে চারটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত, দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। অলিন্দ এবং নিলয়ে রক্ত কোনভাবে মিশ্রিত হতে পারে না এবং দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত পৃথকভাবে প্রবাহিত হয়। ডান অলিন্দ ও ডান নিলয়ে দূষিত রক্ত এবং বাম অলিন্দ ও বাম নিলয়ে বিশুদ্ধ রক্ত থাকে। এই প্রকার হৃদপিণ্ডটিও দ্বিচক্রী এবং মহাধমনী একটি পালমোনারি আর্চ এবং একটি সিস্টেমিক আর্চে বিভক্ত।

পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের হৃদপিণ্ডের চিত্র - প্রাণীদের অভিব্যক্তির সপক্ষে মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের সাদৃশ্য জনিত প্রমাণ
পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের হৃদপিণ্ড

পর্যালোচনা

মেরুদণ্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, হৃদপিন্ডের মৌলিক কাঠামো সকল মেরুদন্ডী শ্রেণীতে একই রকম, শুধুমাত্র গঠনগত জটিলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

1. বিপাক ক্রিয়ার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি অঙ্গে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে হৃৎপিণ্ডের জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

2. জলে বাস করায় মাছের বিপাকক্রিয়ার হার সর্বনিম্ন, তাই এদের হৃদপিণ্ড সরল প্রকৃতির এবং এতে সর্বদা দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয়।

3. উভচর এবং সরীসৃপের বিপাক ক্রিয়া তুলনামূলক বেশি হওয়ায় হৃদপিণ্ডটি গঠনগতভাবে অধিক জটিল হয়েছে। এখানে অলিন্দে দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত পৃথক থাকে।

4. পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিপাক হার সর্বোচ্চ হওয়ায়, এদের হৃৎপিণ্ডটিও সর্বাধিক জটিল প্রকৃতির হয়েছে। এখানে সমস্ত অঙ্গে অধিক পরিমাণে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত দ্রুত সরবরাহের জন্য বিশুদ্ধ ও দূষিত রক্ত সম্পূর্ণরূপে পৃথক থাকে, ডান অলিন্দ ও ডান নিলয়ে দূষিত রক্ত এবং বাম অলিন্দ ও বাম নিলয় বিশুদ্ধ রক্ত থাকে।

মন্তব্য

বিপাক হারের সঙ্গে ক্ষমতা রক্ষা করে মেরুদন্ডী প্রাণীদের অর্থাৎ মাছ থেকে স্তন্যপায়ী পর্যন্ত হৃদপিণ্ড সরল থেকে ক্রমশ জটিল এবং জটিলতর হয়েছে। সুতরাং সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীর হৃদপিন্ডের মৌলিক গঠন এক এবং এই বৈশিষ্ট্যটি মেরুদন্ডী প্রাণীদের একই উদবংশীয় জীব থেকে  সৃষ্টি হওয়াকে নির্দেশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *