নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ (মধ্য ও নিম্ন গতি)

নদী মূলত মধ্যবর্তী ও নিম্ন গতিতে পার্শ্বক্ষয়, অবক্ষেপণ ও সঞ্চয় -এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ গড়ে তোলে।

মধ্য গতিতে নদী যেসব ভূমিরূপ গড়ে তোলে তা হল-

1) পলল শঙ্কু (Alluvial Cone)

নদীর মধ্যগতিতে পর্বত পাদদেশে নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে শঙ্কু আকৃতির যে ভূমিরূপ তৈরি করে তাকে পলল পলল শঙ্কু বলে।

উৎপত্তি:

পার্বত্য প্রবাহ অতিক্রম করার পর নদী সমভূমিতে পতিত হলে, ভূমিধানে তারতম্য ঘটার কারণে নদীর বহন ক্ষমতা ও গতিবেগ দুই’ই হ্রাস পায়। এর ফলে পর্বতের পাদদেশে নদীবাহিত বালি, নুড়ি, কাকর, প্রস্তরখন্ড প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে শঙ্কু আকৃতির তিনকোনা ভূমিভাগ সৃষ্টি করে।

বৈশিষ্ট্য:

i) পলল শঙ্কু সাধারণত শঙ্কু বা মোচার আকৃতি বিশিষ্ট হয়।
ii) পাশাপাশি একাধিক পলল শঙ্কু মিলিত হয়ে পলিমঞ্চ গঠন করে।
iii) পলল শঙ্কু 1 ডিগ্রি থেকে 15 ডিগ্রী ঢাল যুক্ত হয়।
iv) এই প্রকার ভূমিরূপ সাধারণত পর্বতের পাদদেশে গড়ে ওঠে।

উদাহরণ:

ভারতের কোশী নদীতে এই ভূমিরূপ পরিলক্ষিত হয়।

2) পলল ব্যজনী (Alluvial Fan)

পলল শঙ্কু নদী বিধৌত হলে অর্ধ গোলাকার আকৃতিতে ভাগ হয়ে হাতপাখা আকৃতির ভূমিরূপ গঠন করে, একে পলল ব্যজনী বলে।

বৈশিষ্ট্য:

i) পলল ব্যজনী অর্ধ গোলাকৃতি বা ধনুকাকৃতি বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
ii) মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালি কণা দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে।
iii) পলল ব্যজনী মৃদু ঢাল যুক্ত 10 থেকে 50 ডিগ্রী এবং আয়তন কয়েক কিমি পর্যন্ত হতে পারে।
iv) জলপ্রবাহ বেশি কিন্তু পলির পরিমাণ কম এই রূপ নদী পলল ব্যজনী সৃষ্টির পক্ষে আদর্শ।
v) পলল ব্যজনী ‘র হাতপাখার মত আকৃতি বিশিষ্ট অংশটিকে অ্যাপ্রন (Apron), শীর্ষ দেশের সংকীর্ণ অংশটিকে এপেক্স (Apex) বলে।

উদাহরণ:

ঘর্ঘরা, গণ্ডক, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসংখ্য পলল ব্যজনী লক্ষ্য করা যায়।

পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু চিত্র - নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু

3) অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Horse Shoe Lake)

নদীর মধ্য ও নিম্নগতিতে সৃষ্ট ঘোড়া বা গরুর খুরের মত আকৃতি বিশিষ্ট মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন নদী খাতকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলে।

উৎপত্তি:

সমভূমি প্রবাহে নদী এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হওয়ার সময় তার নিম্নক্ষয় একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সামান্য পরিমাণ পার্শ্ব ক্ষয় হয় ঘটে থাকে। এর  প্রভাবে নদীর বাঁক ক্রমশ বাড়তে থাকে।

কোন বাঁকের অবতল পাড়টি যখন বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং বাহিত উপাদান উত্তল পাড়ে সঞ্চিত হতে থাকে তখন নদীর বাঁক বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় বাঁকের মধ্যবর্তী স্থান সংকীর্ণ হয়ে লুপ্ত হয়।

দুটি বাঁকের মধ্যবর্তী বিলুপ্ত হলে নদী সোজা পথে বয়ে চলে আর পরিত্যক্ত অংশটিতে কাদা, বালি এবং জল জমে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করে।

বৈশিষ্ট্য:

i) অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ প্রধানত নদীর মধ্য ও নিম্ন গতিতে সৃষ্টি হয়।
ii) এই হ্রদ দেখতে অনেকটা ঘোড়ার বা গরুর খুরের মত হয়।
iii) নদীর মধ্য ও নিম্নপ্রবাহে অসংখ্য বাঁকের উপস্থিতি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টির পক্ষে আদর্শ।
iv) বিহার ও উত্তরপ্রদেশে এগুলি কোর বা তাল হিসাবে পরিচিত।

উদাহরণ:

মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে, চীনের ইয়াংসিকিয়াং নদীর বদ্বীপ প্রবাহে এরূপ অসংখ্য হ্রদের দেখা মেলে।

অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ চিত্র - নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ

4) নদী বাঁক (Meander)

মধ্য ও নিম্ন গতিতে নদীর আঁকাবাঁকা সর্পিল গতিপথকে মিয়েন্ডার (Meander) বা নদীবাঁক বলে।

উৎপত্তি:

মধ্য ও নিম্নপ্রবাহ ভূমির ঢাল হ্রাস পাওয়া এবং নদী বাহিত বোঝার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার ফলে নদী প্রায় শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
এই সময় সামান্য বাধার সম্মুখীন হলে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন ঘটায় এবং এঁকেবেঁকে সর্পিলাকার পথে প্রবাহিত হয়, একে মিয়েন্ডার বা নদীবাঁক বলে।

বৈশিষ্ট্য:

i) তুরস্কের বাঁক বহুল Meandors নদীর নাম অনুসারে এই ভূমিরূপের নাম হয়েছে Meander
ii) এই প্রকার ভূমিরূপ প্রধানত নদীর মধ্য ও নিম্নগতিতে দেখতে পাওয়া যায়।
iii) নদী বাঁকের যে অংশে জলস্রোত আঘাত করে সেই অংশে ক্ষয় এবং বিপরীত অংশে সঞ্চয় কার্য সংঘটিত হয়। নদীবাঁকের এই সঞ্চয়কে Point Bar বলে।
iv) নদী বাঁকের ফলে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ:

ভাগীরথী, জলঙ্গি, গঙ্গা নদীতে অসংখ্য নদী বাঁক দেখা যায়।

নদী বাঁক চিত্র - নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
নদী বাঁক

নিম্ন গতিতে প্রধানত নদী যেসব ভূমিরূপ গড়ে তোলে তা হল-

1) প্লাবন সমভূমি (Flood Plain)

নদীর নিম্ন গতিতে প্লাবনের ফলে নদীর উভয় তীরে পলি বালি নুড়ি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি সৃষ্টি করে তাকে প্লাবন সমভূমি বলে।

উৎপত্তি:

নদীর সমভূমি প্রবাহে ভূমির ঢাল কম হওয়ার দরুন নদীবাহিত উপাদান সমূহ নদীবক্ষে সঞ্চিত হয়ে নদীখাতের গভীরতা হ্রাস পায়।

এর ফলে নদী খাতের জল বহন ক্ষমতা হ্রাস পায়, এই অবস্থায় বর্ষার অতিরিক্ত জল প্রবাহ নদীর দুই তীরকে প্লাবিত করে এবং নদীবাহিত উপাদান সমূহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে থিতিয়ে পড়ে।

এইভাবে নদীর উভয় তীরে পলি সঞ্চিত হয়ে হয়ে প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি করে।

বৈশিষ্ট্য:

i) প্লাবন সমভূমি গুলি সমতল প্রকৃতির ও উর্বর প্রকৃতির হয়ে থাকে।
ii) প্রধানত নদীর নিম্ন অববাহিকায় প্লাবনভূমি সৃষ্টি হয়।
iii) এই সমভূমি গুলির দৈর্ঘ্য প্রায় 50 থেকে 60 কিলোমিটার ও প্রস্থ কয়েকশো মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
iv) প্লাবনভূমিতে অনেক সময় স্বাভাবিক বাঁধ, জলাভূমি দেখতে পাওয়া যায়।

উদাহরণ:

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদীর গতিপথে প্লাবনভূমি লক্ষ্য করা যায়।

2) স্বাভাবিক বাঁধ (Natural Levee)

সমভূমি প্রবাহে নদীর উভয় তীরে পলি, কাদা, বালি, নুড়ি সঞ্চিত হয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে যে বাঁধের সৃষ্টি হয় তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে।

উৎপত্তি:

নদীর নিম্নগতি বা সমভূমি প্রবাহে অগভীর নদী উপত্যকা বর্ষার অতিরিক্ত জল বহন করতে না পেরে প্রায়সই প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এর ফলে নদীবাহিত উপাদানসমূহ নদীর দুই কূলে সঞ্চিত হয়ে প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি করে ও নদী খাতের ঠিক পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সর্বাধিক পরিমাণে পলি সঞ্চিত করে।

দীর্ঘদিন ধরে এই পলি সঞ্চিত হতে হতে নদীখাত ও প্লাবন ভূমির মধ্যবর্তী অংশে বাঁধের ন্যায় উঁচু হয়ে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বাঁধ সৃষ্টি করে।

বৈশিষ্ট্য:

i) স্বাভাবিক বাঁধ নদীর গতিপথের সমান্তরালভাবে গঠিত হয়।
ii) প্লাবনভূমির তল থেকে স্বাভাবিক বাঁধের উচ্চতা 2 থেকে 4 মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
iii) স্বাভাবিক বাঁধ নদীর দিকে খাড়া ঢাল ও প্লাবনভূমির দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে যেতে থাকে।
iv) স্বাভাবিক বাঁধ অনেক সময় নদীর বন্যা প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
v) অনেক সময় স্বাভাবিক বাঁধের পশ্চাতে জলাভূমি সৃষ্টি হয়ে থাকে।

উদাহরণ:

ভাগীরথী নদী গতিপথে, মিশরের নীল নদের গতিপথে অনেক স্বাভাবিক বাঁধ পরিলক্ষিত হয়। উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি নদীর গতিপথে তৈরি হবার স্বাভাবিক বাঁধ পৃথিবীর দীর্ঘতম (611km) স্বাভাবিক বাঁধ।

প্লাবন সমভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ চিত্র - নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
প্লাবন সমভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ

3) ব-দ্বীপ (Delta)

নদীর মোহনা সংলগ্ন অংশে নদীবাহিত উপাদানসমূহ যেমন পলি, বালি, নুড়ি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে বাংলা মাত্রাহীন ব অক্ষর বা গ্রিক অক্ষর ডেল্টা’র ন্যায় যে ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় তাকে ব-দ্বীপ বলে।

উৎপত্তি:

মোহনার কাছাকাছি আসতে নদীর গতিবেগ একেবারে কমে যায়। এর ফলে নদী বাহিত উপাদানসমূহ নদীবক্ষে সঞ্চিত হতে থাকে এবং নদীর গভীরতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।

এইভাবে নদীবক্ষে পলি সঞ্চিত হতে হতে ব-দ্বীপের উৎপত্তি ঘটে।

আবার অনেক সময় নদীর গতিবেগ যেহেতু খুবই ধীর হয়, তাই প্রবাহ পথে কোন বাধার সম্মুখীন হলে নদী শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই দুই শাখার মধ্যবর্তী অংশে পলি সঞ্চয় ঘটে। এভাবেই ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়

বৈশিষ্ট্য:

i) মূলত সমভূমির ক্ষীণ প্রবাহ ও পর্যাপ্ত বস্তুভার ব-দ্বীপ সৃষ্টির প্রধান কারণ।
ii) নীল নদের মোহনায় নদীর সঞ্চয়জাত ত্রিকোণাকার ভূমিরূপ দেখে গ্রীক পন্ডিত হেরোডেটাস গ্রীক অক্ষর ডেল্টা সাথে সাদৃশ্য রেখে এই প্রকার ভূমিরূপ এর নামকরণ করেন ডেল্টা
iv) ব-দ্বীপ বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে, যেমন-
ধনুকাকৃতি ব-দ্বীপ, পাখির পায়ের আকৃতি বিশিষ্ট ব-দ্বীপ, ত্রিকোণাকার ব-দ্বীপ প্রভৃতি।

উদাহরণ:

গঙ্গাব্রহ্মপুত্র নদীর মিলিত ব-দ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ।

ব-দ্বীপ চিত্র - নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
ব-দ্বীপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *