অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখন্ড নিজেদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ধরনের ধরনের হওয়া উচিত সেই নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে পাস হওয়া চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইনের একটি ধারায় বলা হয় যে ভারতের জনশিক্ষার জন্য কোম্পানি প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবে।
জনশিক্ষা কমিটি গঠন
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারতের জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়।
প্রাচ্য প্রাশ্চাত্য বিতর্ক
১৮২০ দশকে ভারতে জনশিক্ষা প্রসারকে কেন্দ্র করে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য বিতর্ক তীব্র হতে শুরু করে। প্রাচ্যবাদী (Orientalist) অর্থাৎ যাঁরা চান ভারতে প্রাচ্য সনাতনী সাহিত্য, দর্শন বিষয়ে শিক্ষাচর্চার প্রসার ঘটাতে এবং অপর পক্ষে প্রাশ্চাত্যবাদী (Occidentalist) অর্থাৎ যাঁরা চান এ দেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের বিস্তার ঘটানো।
এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন, এদেশীয় রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ প্রাচ্যবাদীরা চাইতেন এদেশে দেশীয় ভাষায়, সনাতনী শিক্ষা বিস্তার ঘটনো। অপরপক্ষে চার্লস গ্রান্ট, টমাস ব্যাবিংটন মেকলে প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীদের মত ছিল এদেশে পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করা।
ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিলে রাজা রামমোহন রায় প্রবল বিরোধিতা করেন পরিবর্তে পাশ্চাত্য শিক্ষাচর্চা প্রবর্তনের দাবি জানান।
প্রাচ্য প্রাশ্চাত্য দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মত সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, মেকলে মিনিটের ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করেন।
মেকলে মিনিট
বড়োলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর আমলে ( ১৮২৮-১৮৩৫) টমাস ব্যবিংটন মেকলে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের পরিষদে আইন সদস্যরুপে যোগ দেন ও পরবর্তীকালে শিক্ষাসভার সভাপতি হন। তিনি ছিলেন উগ্র পাশ্চাত্যবাদী। ভারতীয় প্রাচ্য ভাষা সম্পর্কেও তিনি ছিলেন খুবই বিরূপভাবাপন্ন এবং প্রাচ্য ভাষা সমূহকে তিনি প্রাণহীন, অকেজো, কলুষতাপূর্ণ আখ্যা দেন। তাই এদেশে শিক্ষা প্রসারে পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ২ ফেব্রুয়ারি একটি সুপারিশ করেন যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।
তিনি তাঁর মতে সমর্থনে যুক্তি দেন যে-
- ১) সংস্কৃত ও আরবি ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন এবং ইউরোপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর হওয়ার দরুণ এই ভাষা গুলি শিক্ষার বহন রূপে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে ” ভাল ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি একক শেলফ ভারত ও আরবের সমগ্র দেশীয় সাহিত্যের সমকক্ষ।” (A single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia)
- ২) প্রাচ্য শিক্ষাচর্চা আদিম, বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার থেকে নিকৃষ্ট।
- ৩) তাঁর মতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের অফুরন্ত খনি।
- ৪) মেকলের মতে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা যেমন ইংরেজি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি ইংরেজি ভাষাও ভারতীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে।
- ৫) এদেশ উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি বা চুইঁড়িয়ে পড়া নীতি অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধারণ দেশবাসীর মধ্যেও পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়বে।
- ৬) ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হলে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় নবজীবনের সূচনা হবে এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারী নিয়োগ করা সম্ভব হবে।
- ৭) পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসার ঘটলে এই দেশে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা রক্ত, বর্ণে ভারতবাসী হলেও রুচি, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ব্রিটিশভাবাপন্ন।
মূল্যায়ন
বলা বাহুল্য টমাস ব্যবিংটন মেকলে তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সম্পর্কে যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, এদেশীয় বুদ্ধিজীবী ও প্রাচ্যবাদীদের কাছে যেমন সমালোচিত হয়েছেন তেমনি পাশ্চাত্যবাদী ও স্বদেশী অনেকের কাছে সমভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। প্রাচ্য প্রাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মত সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও এর ফল ছিল মিশ্র।
যেমন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমকে সরকারি হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভারতবর্ষে নিরক্ষরতার পথ আরও প্রশস্ত হয়। গণশিক্ষার গতি অত্যন্ত শ্লথ হয়ে পড়ে।
আবার আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ভারতবাসী ও বাঙালির মধ্যে বাস্তবিকই এক নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
উপসংহার
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারেরের অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বাংলার মত অনুরূপ বিতর্ক তৈরি হয়নি। সেই সকল স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছিল। মেকেলে মিনিট প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সরকারি অর্থ অন্যান্য প্রদেশের সাথে বাংলা প্রদেশেও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার ইতিহাসে এই বিতর্ক এবং মেকলে মিনিট ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।