মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ, বিস্তার, ফলাফল ও গুরুত্ব

ভারতের ছোটনাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাজুড়ে মুন্ডা উপজাতিদের আবাসস্থল। এই মুন্ডা উপজাতিরা তাদের ‘ধরতি আবা‘ বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মুন্ডাদের এই বিদ্রোহ ‘উলগুলান’ বা ভয়ংকর বিশৃংখল নামেও পরিচিত।

বিদ্রোহের কারণ

একটি বিপ্লব বা বিদ্রোহ কেবল একটি কারণের জন্য সংগঠিত হতে পারে না। এর পেছনে থাকে একাধিক কারণ।

ক) প্রচলিত যৌথ কৃষি ব্যবস্থার ভাঙ্গন

উপজাতি মুন্ডাদের কৃষি ব্যবস্থার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো খুৎকাঠি প্রথা, অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানা। তবে ব্রিটিশরা চেয়েছিল তাদের এই প্রথাকে সরিয়ে দিয়ে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা প্রথা চালু করতে, যা মুন্ডাদের মনে ক্ষোভের জাগরণ ঘটায়।

খ) দিকুদের আগমন

একদিকে যখন মুন্ডারা জমির খুৎকাঠি প্রথার উচ্ছেদ নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ে সুযোগ বুঝে বহিরাগত দিকুদের আগমন ঘটে। এই দিকুরা হল জমিদার মহাজন ঠিকাদার যারা ছলে বলে কৌশলে চেয়েছিল মুন্ডাদের জমিগুলোকে নিজেদের আওতাভুক্ত করতে।

গ) অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার পরিবর্তন

আদিবাসী মুন্ডাদের চিরাচরিত আইন, বিচার ব্যবস্থা ও রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সরকার পরিবর্তন নিয়ে আসতে চেয়েছিল যা মুন্ডারা সহ্য করতে পারেনি। এতদিন পর্যন্ত মুন্ডারা নিজেদের সমস্ত সমস্যার সমাধান নিজেরা করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ আইন আসার পর তাদেরকে সেই সমস্যার সমাধানস্বরূপ আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। যা তাদের ক্ষোভকে বৃদ্ধি করে।

ঘ) অতিরিক্ত কর ও বেগার শ্রম

ব্রিটিশদের অত্যাচারের পাশাপাশি জমিদার ও সুদখোর মহাজনেরা মুন্ডাদের উপর নানা পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। এছাড়া কৌশলে তাদের উপর চড়া সুদ ও করের বোঝা চাপিয়ে দিত। সেই সঙ্গে ছিল বেগারি প্রথা। যেখানে বিনা পারিশ্রমিকে মুন্ডাদের জমিদার ও মহাজনদের কাছে কাজ করতে হতো। ফলে তাদের সহ্যেরসীমা কমতে থাকে।

ঙ) ধর্ম পরিবর্তনের চেষ্টা

খ্রিস্টান মিশনারিগুলি মন্ডাদের ধর্মান্তরিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখাতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে তারা সফল না হলে জোর করে তাদের ধর্মান্তরিতকরনের চেষ্টা করলে সকল মুন্ডাদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

চ) চা বাগানে শোষণ

অর্থের লোভ দেখিয়ে ব্রিটিশরা সরল মুন্ডাদের আসামের চা বাগানে নিয়ে যেত শ্রমিক হিসাবে। কিন্তু সেখানেও তারা শোষিত হতে থাকে দিনের পর দিন।

ছ) সরলতার সুযোগ

বহিরাগত দিকুরা মুন্ডাদের সারলে সুযোগ নিয়ে পয়সার লোভ দেখিয়ে অথবা নেশাগ্রস্ত করে তাদেরকে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি লিখে নিত।

জ) অরণ্যকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞা

মুন্ডার অরণ্যের বাসিন্দা হওয়ার জন্য অরণ্যেকই তারা নিজের ঘরবাড়ি মনে করত। কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সেই অরণ্যের সর্বত্র তাদের ইচ্ছেমতো যাওয়া বা তাসাবাদে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহের বিস্তার বা ব্যাপ্তি

এই আদিবাসী বিদ্রোহীটি রাঁচি, বাসিয়া, তোরপা, তামার, চন্দ্রধরপুর, সিংভূম প্রভৃতি ভারতের ছোটনাগপুর ও ঝাড়খন্ড সংলগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গয়া মুন্ডার সেনাপতিত্বে ও বিরসা মুন্ডার নায়কত্বে আন্দোলন একটি আলাদা মাত্রা অর্জন করে। এরা সরকারি কার্যালয়, থানা আক্রমণ করে।

ফলাফল

একটি আন্দোলন বা বিদ্রোহ যখন তৈরি হয় তখন তার কারণে সঙ্গে বেশ কিছু ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। এগুলি নিম্নরূপ

i) প্রজাস্বত্ব আইন পাস

আদিবাসী মুন্ডাদের বিদ্রোহের জন্য ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় তাদের কৃত অভিযোগ গুলি শুনতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। যার ফলেই পাস হয় ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (১৯০৮)

ii) খুৎকাঠি প্রথার পুনরাগমন

প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে খুৎকাঠি প্রথার পুনরাগমন ঘটে  মুন্ডাদের মধ্যে।

iii) বেগার শ্রম নিষিদ্ধকরণ

আইন করে ব্রিটিশরা মুন্ডাদের দিয়ে বেগার খাটানোকে বন্ধ করে।

iv) রাজনৈতিক চেতনা

ব্রিটিশদের নীতি জমিদারদের নিন্দনীয় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সরল মন্ডাদের মনের গভীরে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে।

v) জাতীয় চেতনাবোধ জাগরণ

মুন্ডাদের উপরে অত্যাচার দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও তারা সহ্য করেছে। তবে একান্ত সহ্যের সীমা অতিক্রমের ফলশ্রুতি সকল মুন্ডা উপজাতিদের একত্রে বিদ্রোয় ঝাঁপিয়ে পড়া, যা তাদের জাতীয় চেতনা জাগরণ ঘটায়।

গুরুত্ব

উপজাতি বিদ্রোহের ইতিহাসে এই বিদ্রোহের গুরুত্ব সত্যিই অনন্য। তবে এই বিদ্রোহে অনেক মুন্ডা প্রাণ হারালেও তারা বিদ্রোহকে থামিয়ে দেয়নি। কিন্তু তাদের পথপ্রদর্শক  বিরসা মুন্ডার কারাগার ও মৃত্যু আন্দোলনকে স্থিমিত করে দেয়।

i) এই আন্দোলন দ্বারা উপজাতি শ্রেণি এক বিশেষ সাহসিকতা অর্জন করে।

ii) শব্দ সমাজের আড়ালে থেকেও সভ্যদের সঙ্গে যুদ্ধে যে জয়লাভ করা সম্ভব তা মুন্ডা বিদ্রোহ সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে নজির তৈরি করতে সক্ষম হয়। যার ফলশ্রুতি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ।

iii) এই যুদ্ধ দ্বারা মুন্ডারা নিজেদের অধিকার বোধের প্রতিষ্ঠা করে।

iv) ব্রিটিশ শক্তি প্রাথমিকভাবে তাদের বিদ্রোহকে হালকা ভাবে নিলেও পরবর্তীকালে তাদের এই অদম্য শক্তি ও এক কথা বল ব্রিটিশদের মনেও ভীতি সঞ্চার করে।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে বলা চলে কোন বিদ্রোহ দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। মুন্ডা বিদ্রোহ ঠিক তাই। গহন অরণ্যে তাদের আবাস হলেও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের চিৎকার পাশ্চাত্য শিক্ষার অধিকারী ব্রিটিশদেরও পদদলিত করে।

তাই শরৎ রায় তার The Curious History of a Munda fanatic গ্রন্থে লেখেন বিরসা বললেন “এই শয়তান গুলিকে হত্যা করলেই এই দেশ হবে আমাদের। জমির মালিক হব আমরা“।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *