ভারতের বামপন্থী আন্দোলনে মানবেন্দ্র রায়ের ভূমিকা

ভুমিকা

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই আন্দোলন চিন সহ ভারতের মতো দেশেও ব্যপক প্রভাব ফেলেছিল।

এরফলে বিশের দশক থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী মতাদর্শ ও আন্দোলন দারুণ ভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। আর ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের বিস্তারে যে সমস্ত ব্যক্তি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। যিনি মানবেন্দ্র নাথ রায় বা এম.এন. রায় নামেই অধিক জনপ্রিয়।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বামপন্থীদের অবদান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না। জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ প্রথমসারীর কংগ্রেস নেতা বামপন্থী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আর এই বামপন্থী আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে যার অবদান ভোলার নয়, তিনি হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়।

প্রাথমিক জীবন

নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য ১৮৮৭ সালের ২১শে মার্চ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার আরবেলিয়ায় জন্ম গ্রহন করেন।

উনিশ শতকের শেষ দিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়ে তাঁর মধ্যে বিপ্লবী জাতিয়তাবাদ জেগে উঠে। বিপ্লবী কাজকর্ম করতে গিয়ে তিনি একাধিক ছদ্ম নাম ব্যবহার করেছে, যেমন ডা. মাহমুদ, মি. ব্যানার্জী, মি. মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট ইত্যাদি। তবে মানবেন্দ্র নাথ রায় বা এম.এন. রায় নামেই তিনি অধিক পরিচিতি লাভ করেন।  

প্রাথমিক জীবনে মানবেন্দ্র নাথ রায় অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

পরবর্তীতে হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় রায়কে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে ‘বাঘাযতীন’-র কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘বাঘাযতীন’-এর নির্দেশে জার্মানি থেকে অস্ত্রসংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯১৫ সালে তিনি ভারত ত্যাগ করে। যদিও অস্ত্রসংগ্রহের এই পরিকল্পনা সফল হয়নি।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা

পরবর্তীতে তিনি মেক্সিকোতে গিয়ে সোশ্যালিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন।

মেক্সিকোতেই বিশিষ্ট রুশ বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধি মিখাইল বোরোদিনের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। এই প্রথম রাশিয়ার বাইরে মেক্সিকোতে বোরোদিন উদ্যোগে ও রায়ের সভাপতিত্বে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় নামে পরিচতি লাভ করেন ।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই থেকে ৭ই আগস্ট রাশিয়ার মস্কোয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশেনালের (Comintern) দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। লেলিনের আমন্ত্রনে মেক্সিকো কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়।

১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, খিলাফৎ নেতা মহম্মদ আলি ও  মহম্মদ সাফিক সহ ২৪ জন মুহাজিরিনকে নিয়ে রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন।

এরপর ১৯২২ সালে বার্লিন থেকে বিভিন্ন পত্রিকা মারফত ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। এখান থেকেই তিনি ‘Vanguard of Indian Independence’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা ডাক যোগের মাধ্যমে ভারতে পাঠাতে থাকেন।

ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিতে বহুবার এই পত্রিকার নাম পরিবর্তন করা হলেও, বারবার ব্রিটিশ সরকার তা নিষিদ্ধ করে দেয়। এই সময়ে মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘India in Transition’ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থ পড়ে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তবরকতউল্লাহ সহ বহু প্রবাসী ভারতীয় মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন।

ভারতে বামপন্থী ভাবধারার প্রসার

বামপন্থী আন্দোলন ভারতের বাইরে শুরু হলেও, ভারতের মধ্যে সাম্যবাদী ভাবধারা প্রসারের জন্য তৎপর হন মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনি নলিনী গুপ্ত, মহম্মদ শরিফ, ফিরোজ উদ্দিন মনসুর, আব্দুল মজিদ, রফিক আহমেদশওকত ওসমানিকে ভারতে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচারের জন্য পাঠান।

১৯২১ সালে মুজাফর আহমেদের নেতৃত্বে কলকাতায় এবং এস.এস ডাঙ্গের নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট আন্দোলন ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

তবে মানবেন্দ্রনাথ রায় যে সব কমিউনিস্টদের ভারতে সাম্যবাদ প্রচারের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন, তাদের অনেককেই পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার।

এই মামলা ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল। অন্যদিকে ১৯২৪ সালের মে মাসে নলিনী গুপ্ত, মুজাফর আহমেদ, এস এস ডাঙ্গেকে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এসত্ত্বেও ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন দমাতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার।

১৯২৫ সালের শেষে কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয় এবং এটিকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক সূচনা বলে মনে করা হয়। 

উপসংহার

মানবেন্দ্রনাথ রায় চেয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি ভবিষ্যতে কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে উঠবে। তবে ১৯২৯ সালে নানা অভিযোগ এনে তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে তিনি কংগ্রেসে যোগ দিলেও, সেখানেও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ১৯৪০ সালে রেডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তৈরি করেন।  তাই বামপন্থী ভাবধারা ও আন্দোলনের প্রসারের ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথ রায় আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *