দীর্ঘ চার দশক ধরে চলা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল।
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজয়ের পর থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের মাঝের সময়টা দীর্ঘ ১৯০ বছররের ইতিহাস। এই দীর্ঘ সময় ধরে ইংরেজরা ভারত শাসন করেছে, ভারতীয়দের শোষণ করেছে। কিন্তু সেই ইতিহাসে সমুজ্জ্বলে জ্বল জ্বল করছে অসংখ্য বিদ্রোহ, আন্দোলন, ইংরেজদের এই দেশ থেকে উৎখাত করার প্রচেষ্টা।
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ
সময় কাল | ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ |
বিদ্রোহের এলাকা | ঢাকা, পূর্ণিয়া, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, শ্রীহট্ট, মালদহ, রাজশাহী, কোচবিহার, উত্তরবঙ্গ, বিহার |
নেতৃত্ব বৃন্দ | মজনু শাহ, মুশা শাহ, চেরাগ আলি, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি, কৃপানাথ |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ কি
বঙ্গদেশ দখল করেই ইংরেজ চালায় প্রচণ্ড শোষণ আর অত্যাচার। তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল সাধারণ মানুষ। প্রথমে দেখা দিল বঙ্গদেশে কৃষক আর কারিগরদের বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ বাংলা বিহারের বিস্তৃত ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলমান ফকিররা কৃষি ও কারিগরি কাজের সাথে যুক্ত ছিল। বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৩ সালে, চলেছিল ১৮০০ সাল পর্যন্ত। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন এদেশের সন্ন্যাসী আর ফকিরের দল। বিদ্রোহের নাম সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ।
নামকরণ
এই নামকরণটা করেছিলেন তখনকার বঙ্গদেশের গভর্ণর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। যদিও উইলিয়াম হান্টার, এডওয়ার্ড প্রমুখ ইংরেজ ক্যাপ্টন একে কৃষকবিদ্ৰোহ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বিদ্রোহের নেতা
সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের নায়করা ছিলেন মজনু শাহ, মুশা শাহ, চেরাগ আলি, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি, কৃপানাথ প্রমুখ অনেকে।
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের কারণ
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের ঘটার কারণ নিম্নে আলোচনা করা হল-
জমিদার আর মহাজনের শোষণ ও অত্যাচার
সেই সময় মুঘল সাম্রাজ্যের পতন যখন ঘনিয়ে আসছে, দেশের প্রকৃত মালিক হতে চলেছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। আর এদেশের জমিদার আর মহাজনের দল নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সঙ্গ দিয়েছিল ইংরেজদের সাথে।
অত্যাধিক পরিমাণে রাজস্ব কর
এই যুগলবন্দীর ফলে চলল প্রচণ্ড অত্যাচার আর লুঠ-পাট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের উপর অত্যাধিক পরিমাণে রাজস্ব কর ধার্য করা হয়। রাজস্ব না আদায় হলে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হত।
অনেক মানুষজন, কৃষকেরা পালিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এর ফলে দেশে অত্যধিক পরিমাণে চুরি-ডাকাতি সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।
রেশম ও মসলিন ব্যবসায়ী
এর সাথে সাথে কারিগরদের জীবনেও নেমে এসেছিল দুর্যোগ। পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই ইংরেজ বণিকেরা দেশীয় কারিগরদের জিনিসপত্র ক্রয় করে মূল্য দিত খুবই কম।
সেই পণ্য ইউরোপের বাজারে চালান দিয়ে প্রচুর মুনাফা করতে থাকে কোম্পানি।
সে সময়ের ঢাকা অঞ্চলের মসলিন বস্ত্র ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। অনেক কারিগরদের সাথে সন্ন্যাসী ও ফকিরাও এই পেশার সাথে যুক্ত ছিল।
ইংরেজর কর্মচারীরা সেইসব জিনিসপত্র অল্প দামে তাদেরকে বিক্রয় করতে বাধ্য করতো, নরাজি হলে বলপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া হতো।
ব্যবসার নামে এই অমানুষিক উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বাংলা ও বিহারের কারিগরেরা কাজ ছেড়ে, বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতন
মুঘল সাম্রাজ্য তখন লোপ হয়ে আসছে। তাদের বিরাট সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অনেকে এসে যোগ দিল সন্ন্যাসী, ফকির ও কৃষক, কারিগরদের বিদ্রোহী দলে।
তীর্থকর
মুঘল আমল থেকে বিহার আর বঙ্গদেশের নানা অঞ্চলে বহু সন্ন্যাসী আর ফকিরের দল শিষ্যদের নিয়ে হাজারে হাজারে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত, তীর্থ করতে যেত। কোন বাধা ছিল না।
ইংরেজরা এই তীর্থ ভ্রমণে বাধা দিতে থাকে। প্রচুর পরিমাণে তীর্থ-কর বসানো হলো। এর ফলে সন্ন্যাসী ফকিরদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের চরিত্র ও রুপরেখা
১৭৬০ সাল নাগাদ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ধীরে ধীরে রুপ পেতে শুরু করে।
ঢাকার ইংরেজ কুঠির আক্রমণ
১৭৬৩ সালে সন্ন্যাসী ফকির ও কৃষক কারিগরদের বিদ্রোহী দল ঢাকার ইংরেজ বাণিজ্য-কুঠির আক্রমণ করে দখল করে। ইংরেজরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
সেই সময় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’র বড়ো কর্তা ছিলেন ক্লাইভ।
ঢাকার বাণিজ্য কুঠির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রালফ্ লিস্টার।
এই বিদ্রোহের ফলস্বরূপ লিস্টারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এর একমাস পরে এক ইংরেজ সেনাপতি—ক্যাপ্টেন গ্রাণ্ট, কলকাতা থেকে বহু সৈন্য, কামান, বন্দুক নিয়ে এসে কুঠিবাড়িটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেন।
রাজশাহীর ইংরেজ কুঠির দখল
এরপর বিদ্রোহীরা আক্রমণ করে রাজশাহীর রামপুর গোয়ালিয়ার ইংরেজ কুঠি এবং কুঠির পরিচালক বেল্টে সাহেবকে বন্দি করে পাঠানো হয় পাটনায়।
পাটনা তখন বিদ্রোহীদের অন্যতম কেন্দ্রে। সেখানে বেন্টে সাহেবকে হত্যা করা হয়।
সন্ন্যাসী নেতা রামানন্দ গোঁসাই
১৭৬৬ সালে ইংরেজরা চক্রান্ত করে কোচবিহারের রাজার গদি কেড়ে নিতে চাইলে কোচবিহার-রাজা সন্ন্যাসী নেতা রামানন্দ গোঁসাই’র সাহায্য চান।
রামনন্দ তাঁর বিরাট বিদ্রোহী-বাহিনী নিয়ে রাজাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এবং ইংরেজ সেনাপতি লেঃ মরিসনের সঙ্গে যুদ্ধে কামান-বন্দুকধারী ইংরেজ বাহিনীকে পুরোপুরি পরাস্ত করে দেন।
পাটনার ইংরেজ কুঠি আক্রমণ
এর পরের বছর ১৭৬৭ সালে বিদ্রোহীরা দখল করল পাটনার ইংরেজ কুঠি।
সারেঙ্গি জেলার হোসিয়ারপুরে ছিল ইংরেজদের এক দুর্গ। বিদ্রোহীরা সেটিও দখল করে নেয়।
ইংরেজ কুঠি পুনরুদ্ধার
এরপর থেকে ইংলিশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। পাটনার কুঠির দখল বিদ্রোহীরা বেশি দিন রাখতে পারেনি।
ইংরেজরা তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
ইংরেজদের কামান-বন্দুকের সামনে বেশি দিন দাঁড়াতে পারেনি বিদ্রোহীরা।
তারা পালিয়ে যায় হিমালয়ের পাদদেশে তরাই অঞ্চলে, নেপালের সীমান্তে বনে-জঙ্গলে।
হিমালয়ের পাদদেশের জেলাগুলিতে প্রচুর বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নেয় বিদ্রোহীরা।
এখান থেকেই হঠাৎ হঠাৎ ইংরেজদের উপর আক্রমণ করে তারা পালিয়ে যেত।
জলপাইগুড়িতে গড়ে তোলা হয়েছিল দুর্গ। এখান এখান থেকেই বারবার ইংরেজ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান হত।
ওয়ারেন হেস্টিংসের স্বৈরাচারিতা
১৭৭২ সালে গভর্ণর-জেনারেল হন ওয়ারেন হেস্টিংস্।
এর পরপরই বাংলার বুকে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে।
এর ফলে গ্রামে গ্রামে অসংখ্য সাধারণ মানুষ দলে দলে এসে যোগ দেয় বিদ্রোহীদের সাথে।
সারা বঙ্গ-বিহার পরিণত হয় এক মহাবিদ্রোহের রণক্ষেত্র।
স্বাধীন উত্তরবঙ্গ
পূর্ণিয়া, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, শ্রীহট্ট, মালদহ—এই বিরাট অঞ্চল জুড়ে চলতে থাকে বিদ্রোহ।
১৭৭৩ সালে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড নিহত এবং তার ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হন।
একসময় পুরো উত্তরবঙ্গ ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
কিন্তু ইংরেজদের শোষণ এবং শাসন তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং -এর আমলেই তা আরো তীব্রতর রূপ নেয়।
এর ফলস্বরূপ শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসে যার নাম – ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
বিশেষ করে বিহার বঙ্গদেশ গভীর ভাবে আক্রান্ত হল এই দুর্ভিক্ষে। মারা যান প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
এই দুর্ভিক্ষের জন্যে দায়ী ছিল ইংরেজ বণিক, জমিদার-মহাজনেরা।
ব্যর্থতার কারণ
দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত নানা কারণে ১৮০০ সাল নাগাদ পুরোপুরিভাবে স্থিমিত হয়ে যায়।
এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দুর্বল নেতৃত্ব।
এছাড়াও অনভিজ্ঞতা, আনুন্নত যোগাযোগ এবং ধর্মীয় ভেদাভেদের জন্য বিদ্রোহীরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি।
কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় ফকির মজনু শাহকে ইংরেজরা একবারও পরাস্ত করতে পারেনি। ১৭৮৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৭৮৭ সালে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের ইংরেজ সৈন্যদের দ্বারা সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ভবানী পাঠক দুই সহকারী সহ নিহত হন।
ভবানী পাঠক এবং মজনু শাহের মৃত্যুর পর মুসা শাহ, চেরাগা আলি, চেরাগ আলি, কৃপানাথ, দর্পদেব, ফেরাগুল শাহ প্রমুখ নেতা বিদ্রোহ চালানোর চেষ্টা করে গেলেও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে একসময় গতিশীলতা হারায় এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
ফলাফল
সন্ন্যাসী বিদ্রোহে ইংরেজদের এদেশ থেকে তাড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে এই বিদ্রোহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বাংলা তথা ভারতবাসীর বিপ্লবী জনসাধারণের মনে দীর্ঘকাল ধরে প্রেরণা যুগিয়েছে।