অক্সিন কি ? বৈশিষ্ট্য এবং কাজ

অক্সিন হল বৃদ্ধি সহায়ক একটি প্রধান উদ্ভিদ হরমোন। 1880 খ্রিস্টাব্দে  চার্লস ডারউইন বিভিন্ন পরীক্ষা লব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে অক্সিনের আধুনিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত। ভেন্ট (Went) 1928 খ্রিস্টাব্দে জই উদ্ভিদের (Avena sativa) ভ্রুণ মুকুল আবরণীতে নানান পরীক্ষা করে অক্সিনের উপস্থিতি প্রমাণ করেন। তিনিই প্রথম উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক এই হরমোনটিকে অক্সিন নামে অভিহিত করেন।

সংজ্ঞা (Definition)

উদ্ভিদের অগ্রস্ত ভাজক কলা থেকে উৎপন্ন নাইট্রোজেন ঘটিত অম্লধর্মী বৃদ্ধি সহায়ক যে উদ্ভিদ হরমোন, মূলত নিম্নাভিমুখে পরিবাহিত হয় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, তাকে অক্সিন বলে।

উৎস

মুল ও কাণ্ডের অগ্রস্ত ভাজক কলা, অপরিণত পাতা, ভ্রুণ মুকুল আবরণী, পরাগরেণু , ইত্যাদি।

রাসায়নিক গঠন

অক্সিন কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন দ্বারা গঠিত ইন্ডোল বর্গযুক্ত জৈব অ্যাসিড যার রাসায়নিক নাম হল ইন্ডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিড (C10H9O2N)।

ইন্ডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিড (IAA) - অক্সিন কি - বৈশিষ্ট - এবং - কাজ

প্রাকৃতিক অক্সিন

1.  ইন্ডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিড (IAA)
2.  ইন্ডোল অ্যাসিটো নাইট্রাইল (IAN)
3.  ইন্ডোল পাইরোভিক অ্যাসিড (IPA)

কৃত্রিম অক্সিন

1. ন্যাপথক্সি অ্যাসিটিক অ্যাসিড
2. 2, 4 ডাইক্লোরো ফেনক্সি অ্যাসিটিক অ্যাসিড (2, 4-D)
3. 2, 4, 5 ট্রাইক্লোরো ফেনক্সি অ্যাসিটিক অ্যাসিড (2, 4, 5-T)
4. ইন্ডোল বিউটরিক অ্যাসিড (IBA)

অক্সিনের বৈশিষ্ট্য

1. অক্সিন উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী এক প্রকার হরমোন।
2. এটি কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত এক প্রকার জৈব অ্যাসিড এবং এর রাসায়নিক নাম হল ইনডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিড।
3. অক্সিন ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড থেকে সংশ্লেষিত হয়।
4.  উদ্ভিদের বর্ধনশীল অঙ্গে প্রধানত ভ্রুণ মুকুল আবরণী, কান্ড ও মূলের অগ্রস্থ ভাজক কলাগুলিতে উৎপন্ন হয় এবং ফ্লোয়েম কলার মাধ্যমে নিম্নমুখী পরিবাহিত হয়।
5.  অক্সিন সংশ্লেষ সাধারণত আলো উৎসের বিপরীতে অর্থাৎ অন্ধকারে বেশি হয়।
6. এটি জলে দ্রবণীয় ফলে ব্যাপন ক্রিয়ার মাধ্যমে সহজেই পরিবাহিত হতে পারে।
7.  অক্সিনের ক্রিয়া প্রধানত মেরুবর্তী এবং আলোক জারনের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
8. অনেক ক্ষেত্রে অক্সিনের পার্শ্বীয় পরিবহন এবং উর্ধ্বমুখী পরিবহনও দেখা যায়।
9. মূলের ক্ষেত্রে স্বল্প ঘনত্বে  এবং কাণ্ডের জন্য তুলনামূলকভাবে অধিক ঘনত্বে অক্সিন কাজ করে।
10. ট্রাই আয়োডো বেঞ্জোইক (TIBA) অক্সিনের কাজে বাধা দেয়।

অক্সিনের কাজ

উদ্ভিদের অক্সিনের নিম্নলিখিত কাজ গুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ-

1.  অগ্রস্থ প্রকটতা ও পার্শ্বিক মুকুল বৃদ্ধিতে বাধা দান

অগ্র মুকুলের দ্বারা পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঘটনাকে অগ্রস্থ প্রকটতা বলে। অক্সিন উদ্ভিদের কান্ডের অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায় এবং এর প্রভাবে পার্শ্বীয় মুকুল গুলির বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অর্থাৎ এই হরমোন অগ্রস্থ প্রকটতাকে ত্বরান্বিত করে ফলস্বরূপ উদ্ভিদ লম্বা হয়।

2. কোষ বিভাজন

অক্সিন উদ্ভিদের কোষে DNA এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং কোষ বিভাজনে সাহায্য করে। ক্যাম্বিয়ামকে সক্রিয় করে।

3. কোষের আয়তন বৃদ্ধি

এই হরমোন কোষ প্রাচীরকে নমনীয় করে যার ফলে কোষের আকার আয়তন সহজেই পরিবর্তন হতে পারে। পরিণত কোষে কোষগহ্বর সৃষ্টি করে এবং এই গহ্বরগুলিতে বিভিন্ন পদার্থ সঞ্চিত হয়ে কোষের আকারের বৃদ্ধি ঘটায়।

4. ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ

উদ্ভিদের ট্রাফিক চলন নিয়ন্ত্রণে এই হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন প্রধানত উদ্ভিদের ফটোট্রপিক চলন ও জিও ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ করে। আলোক এবং অভিকর্ষের প্রভাবে অক্সিনের অসম বন্টনের দ্বারা ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রিত হয় (Went, 1928)

i) ফটোট্রপিক চলন

উদ্ভিদের আলোকিত অংশের দিকে কম অক্সিন ও আলোর বিপরীত দিকে বেশি সঞ্চিত হয়। কাণ্ডের কোষ বেশি অক্সিন ঘনত্বে ও মূলের কোষ কম ঘনত্বে কোষের বিভাজন বেশি হয়। সেইজন্য কাণ্ডের অগ্রভাগ আলোর দিকে (Positive phototropic) এবং মূল আলোর বিপরীত দিকে (Negative phototropic) বেঁকে যায়।

ii) জিও ট্রপিক চলন

অনুভূমিকভাবে  শায়িত অবস্থায় চারা গাছে অভিকর্ষের প্রভাবে উদ্ভিদের ভূমি সংলগ্ন অংশে অধিক অক্সিন ও তার বিপরীতে কম সঞ্চিত হয়। ফলে কান্ড অভিকর্ষের বিপরীতে (Negative geotropic) এবং মূল অভিকর্ষের অনুকূলে (Positive geotropic) বৃদ্ধি পায়।

ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে আক্সিনের ভুমিকা Role of auxin in regulating tropic movement
ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে আক্সিনের ভুমিকা

5. মোচন

উদ্ভিদের সাধারণ বৃদ্ধির সময় পরিণত পাতা ফুল ও ফলের স্থানান্তরন ঘটে। উদ্ভিদ অঙ্গের এই স্থানান্তরণকে মোচন (Abscission) বলা হয়। অপরিণত ফুল ও ফলের মোচন অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে ক্ষতিকারক। অক্সিনহরমোনের প্রভাবে অপরিণত ফুল ও ফলের মোচন প্রতিরোধ হয়।

6. অঙ্গের বিভেদ

কম পরিমাণ অক্সিন মূল, কাণ্ড, মুকুল ও ফুলের পরিস্ফুটনে সাহায্য করে।

7. ফল পরিস্ফুটন ও বৃদ্ধি

পরাগযোগ ও নিষেকের পর ডিম্বাশয় এ অক্সিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে ডিম্বাশয় আকারে বৃদ্ধি পেয়ে ফলে পরিণত হয়।

8. পার্থেনোকার্পি

নিষেক ব্যতীত বীজবিহীন ফল উৎপাদনকে পার্থেনোকারপি (Gustafson, 1936) বলে। অক্সিন প্রয়োগ করে কলা, আপেল, আঙ্গুর, প্রভৃতিতে নিষেক ছাড়াই সহজেই বীজবিহীন ফল উৎপাদন করা যায়।

9. লিঙ্গপ্রকাশ

অক্সিন প্রয়োগে একাধিক উদ্ভিদের লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে পারে। Cucurbitaceae গোত্রের ( কুমড়ো, তরমুজ, শসা) একাধিক উদ্ভিদে অক্সিন প্রয়োগ করলে অধিক সংখ্যক স্ত্রী ফুলের সৃষ্টি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *