যে সব পদার্থ দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ত্বক গঠিত হয়েছে সাধারণভাবে তাকে শিলা বলে। পৃথিবীর জন্মের আদি লগ্নে যে শিলার সৃষ্টি হয়েছিল তা হল আগ্নেয় শিলা ।
আগ্নেয় শিলা
গ্রিক শব্দ IGNIS শব্দের অর্থ হলো ‘অগ্নি‘ অর্থাৎ অগ্নুৎপাতের ফলে মূলত যে শিলা সৃষ্টি হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে।
অর্থাৎ উত্তপ্ত তরল অবস্থা থেকে তাপ বিকিরণের ফলে ক্রমশ ঠান্ডা ও শীতল হওয়ার ফলে পৃথিবীর পৃষ্ঠে সর্বপ্রথম যে শিলা সৃষ্টি হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে।
তাছাড়া ভূগর্ভস্থ তরল ম্যাগমা ও ভূত্বকের ফাটল বা ভূপৃষ্ঠে শীতল হয়ে জমাট বেঁধে যে শিলা সৃষ্টি করে তাকে আগ্নেয় শিলা বলে।
আগ্নেয় শিলার বৈশিষ্ট্য
১) আগ্নেয়শিলা হলো প্রাথমিক শিলা। এই শিলা থেকে অনান্য শিলার সৃষ্টি হয়। তাই একে আদি শিলা বা Mother Rock ও বলা হয়।
২) এই শিলা অত্যন্ত কঠিন ও ভারী।
৩) এই শিলায় কোন স্তর ভেদ থাকে না। তাই একে অস্তরীভূত শিলাও বলা হয়।
৪) বেশিরভাগ আগ্নেয় শিলায় ধাতব উজ্জ্বল্য লক্ষ্য করা যায়।
৫) আগ্নেয়শিলায় জীবাশ্ম দেখা যায় না।
৬) এই শিলায় কেলাস গুলি ঘনসন্ধি বিষ্ট হয়।
৭) এই শিলা জল শোষণ করতে পারে না।
৮) পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় 80% শিলাই আগ্নেয় শিলা।
৯) আগ্নেয় শিলায় শীতলী ভবনের ফলে সংকোচন ও আবহাওয়া বিকারের ফলে ফাটল লক্ষ্য করা যায়।
১০) এটি অপ্রবেশ্য শিলা।
আগ্নেয় শিলার শ্রেণীবিভাগ
আগ্নেয় শিলাকে প্রধানত পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-
1) উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
2) রাসায়নিক ধর্ম অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
3) গ্রথন অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
4) উপাদানের উপস্থিতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
5) অবস্থান অনুসারে আগ্নেয় শিলা
1) উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
উৎপত্তি বা শিলার অবস্থান অনুসারে আগ্নেয়শিলা কে মূলত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১) নিঃসারী আগ্নেয় শিলা
২) উদবেধী আগ্নেয় শিলা
১) নিঃসারী আগ্নেয় শিলা
অগ্নুৎপাতের ফলে ভূগর্ভের উত্তপ্ত ও গ্যাস মিশ্রিত গলিত পদার্থ ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। গ্যাস নির্গত হলে ম্যাগমা লাভায় পরিণত হয়। এই লাভা পরে শীতল হয়ে ও জমাট বেঁধে যে আগ্নেয় শিলায় পরিণত হয় সেই আগ্নেয় শিলাকে নিঃসারী আগ্নেয় শিলা বলে।
উদাহরণ- ব্যাসল্ট
নিঃসারী আগ্নেয় শিলার শ্রেণীবিভাগ
নিঃসারী আগ্নেয় শিলাকে উৎপত্তি অনুসারে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়
i) লাভা শিল
ii) পাইরোক্লাস্টিক শিলা
i) লাভা শিল
আগ্নেয়গিরির লাভা ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে যে শিলার সৃষ্টি করে তাকে লাভা শিলা বলে।
যেমন- ব্যাসাল্ট
ii) পাইরোক্লাস্টিক শিলা
পাইরোক্লাস্ট শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ Pur এর অর্থ আগুন থেকে এসেছে, এবং clast শব্দের অর্থ ভাঙ্গা। সুতরাং Pyroclast হল broken by fire অর্থাৎ অগ্ন্যুৎপাতের দ্বারা ভগ্ন।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় নির্গত আগে থেকে জমে কঠিন হয়ে আসা লাভা ছোট ছোট শিলাখণ্ডে পরিণত হয়। একে বলা হয় পাইরোক্লাস্টিক শিলা।
যেমন- টুফ
২) উদবেধী আগ্নেয় শিলা
ভূগর্ভের উত্তপ্ত গলিত পদার্থ অনেক সময় ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে না পেরে ভূগর্ভের ভেতরে বছরের পর বছর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে জমে কঠিন শিলায় পরিণত হয়। সেই কঠিন শিলাকে উদবেধী আগ্নেয় শিলা বলে।
যেমন- গ্রানাইট
উদবেধী আগ্নেয় শিলার শ্রেণীবিভাগ
উদবেধী আগ্নেয় শিলাকে গভীরতা অনুসারে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i) পাতালিক শিলা
ii) উপপাতালিক শিলা
i) পাতালিক শিলা
ভূগর্ভের উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে (10 km অধিক) ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যে কঠিন শিলার সৃষ্টি করে সেই শিলাকে বলা হয় পাতালিক শিলা।
যেমন- গ্রানাইট, গ্যাব্রো
পাতালিক শিলার বৈশিষ্ট্য
a) ভূগর্ভের অনেক গভীরে এর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
b) ধীরে ধীরে শীতল হওয়ার জন্য এই শিলার কেলাসগুলি বড় আকৃতি হয়।
ii) উপপাতালিক শিলা
উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে না পেরে ভূত্বকের ফাটলের মধ্যে শীতল ও কঠিন হয়ে যে শিলার সৃষ্টি করে তাকে বলা হয় উপপাতালিক শিলা।
যেমন- পারফাইরি, ডোলেরাইট
উপপাতালিক শিলার বৈশিষ্ট্য
a) পাতালিক শিলা অপেক্ষা উঁচুতে অবস্থান করে।
b) দ্রুত ও শীতল হওয়ার ফলে শিলার দানা গুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়।
2) রাসায়নিক ধর্ম অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
আগ্নেয় শিলাকে রাসায়নিক গঠন অনুসারে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i) আম্লিক শিলা
ii) ক্ষারকীয় শিলা
iii) মধ্যবর্তী শিলা
iv) অতিক্ষারকীয় শিলা
i) আম্লিক শিলা
যে সমস্ত আগ্নেয় শিলায় সিলিকার পরিমাণ 65% এর বেশি এবং ক্ষারকীয় অক্সাইডের পরিমাণ 35% এর কম তাকে আম্লিক শিলা বলে।
উদাহরণ- গ্রানাইট
আম্লীক শিলার বৈশিষ্ট্য
a) এই শিলার রং হালকা হয়।
b) আপেক্ষিক গুরুত্ব 2.75- 2.8
c) উপাদান- কোমাটর্জ, ফেলস্কার
ii) ক্ষারকীয় শিলা
যেসব আগ্নেয় শিলায় সিলিকার পরিমাণ ও ক্ষারকীয় অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় সমান সমান অর্থাৎ 45%- 55% তাদের ক্ষারকীয় শিলা বলে।
উদাহরণ- ব্যাসল্ট
ক্ষারকীয় শিলার বৈশিষ্ট্য
a) এই শিলার রং গাঢ় রঙ্গিন হয়।
b) আপেক্ষিক গুরুত্ব 2.8-3
c) উপাদান ম্যাগনেসিয়াম।
iii) মধ্যবর্তী শিলা
যে সব আগ্নেয় শিলায় সিলিকার পরিমাণ 55%- 65% এবং ক্ষারকীয় অক্সাইডের পরিমাণ 35%- 45% তাদের মধ্যবর্তী শিলা বলে।
উদাহরণ- ডায়োরাইট
মধ্যবর্তী শিলার বৈশিষ্ট্য
a) এই শিলার রং বেশ গাঢ় হয়।
b) আপেক্ষিক গুরুত্ব 2.75- 2.8
iv) অতিক্ষারকীয় শিলা
যেসব আগ্নেয় শিলায় সিলিকার পরিমাণ 45% এর কম এবং ক্ষারকীয় অক্সাইডের পরিমাণ 55% এর থেকে বেশি তাকে অতি ক্ষারকীয় শিলা বলে।
উদাহরণ- পেরিডোটাইট
অতি ক্ষারকীয় শিলার বৈশিষ্ট্য
a) এই শিলার রং অনেকটা গাঢ় হয়।
b) আপেক্ষিক গুরুত্ব 2.8- 3.4
3) গ্রথন অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
আগ্নেয় শিলার দানাগুলি জ্যামিতিক আকৃতি বিশিষ্ট হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
জ্যামিতিক আকৃতি বিশিষ্ট হলে তা ক্রিস্টাল দানা আবার জ্যামিতিক আকৃতি বিশিষ্ট না হলে তা গ্লাস দানা নামে পরিচিত।
এই ভিত্তি অনুসারে আগ্নেয় শিলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১) গ্রানিটয়েড বা ফ্যানেরাইটিক
২) পেগমাটাইটিক
৩) অ্যালক্ষানিটিক
৪) গ্লাসি
৫) পরফাইরিটিক
১) গ্রানিটয়েড বা ফ্যানেরাইটিক
স্থূল, বড় আকৃতির দানাযুক্ত পাতালিক প্রকৃতির আগ্নেয়শিলাকে গ্রানিটয়েড বা ফ্যানেরাইটিক বলে।
যেমন- গ্রানাইট
২) পেগমাটাইটিক
অতি স্থূল দানাযুক্ত প্রকৃতির আগ্নেয় শিলাকে পেগমাটাইটিক বলে।
যেমন- পেগমাটাইট
৩) অ্যালক্ষানিটিক
এটি মাঝারি গ্রথনযুক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।
যেমন- ব্যাসাল্ট
৪) গ্লাসি
এটি অতি সূক্ষ্ম দানাযুক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।
যেমন- অবসিডিয়ান
৫) পরফাইরিটিক
বড় ও ছোট উভয় প্রকৃতির দানা বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
যেমন- পারফাইরি
4) উপাদানের উপস্থিতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
উপাদানের বৈশিষ্ট্য অনুসারে আগ্নেয় শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১) ম্যফিক জাতীয় আগ্নেয় শিলা
২) ফেলসিক জাতীয় আগ্নেয় শিলা
১) ম্যফিক জাতীয় আগ্নেয় শিলা
এই শিলার মূল উপাদান হলো ম্যাগনেসিয়াম ও লোহা। ম্যাগনেসিয়াম (Mg) ও আয়রন (Fe) এর উপস্থিতির জন্য এই শিলা ম্যফিক নামে পরিচিত।
ম্যাগনেসিয়ামের আধিক্য থাকার জন্য এই শিলা প্রকট ক্ষারধর্মী হয়। ও কালো অথবা গাঢ় ধূসর বর্ণের হয়।
উদাহরণ- কোয়াটর্জ
২) ফেলসিক জাতীয় আগ্নেয় শিল
ম্যাফিক ছাড়া অন্য কোন ধরনের উপাদান জাতীয় আগ্নেয় শিলা পাওয়া যায় তা ফেলসিক শিলা নামে পরিচিত। লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের এত আধিক্য কোথাকার এটি ফেলসিক নামে পরিচিত।
উদাহরণ- অলিভিন
5) অবস্থান অনুসারে আগ্নেয় শিলা
অবস্থান অনুসারে আগ্নেয় শিলাকে মূলত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-
১) সমান্তরালভাবে সঞ্চিত আগ্নেয় শিলা
২) উলম্বভাবে সঞ্চিত আগ্নেয় শিলা
১) সমান্তরালভাবে সঞ্চিত আগ্নেয় শিলা
এই ধরনের উদবেদী শিলা ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল বা ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে অবস্থান করে।
সিল, ল্যাকোলিথ, ফ্যাকোলিথ, ল্যাপোলিথ এই ধরনের শিলা।
২) উলম্বভাবে সঞ্চিত আগ্নেয় শিলা
উদবেধী শিলা যখন ভূপৃষ্ঠে উলঙ্গ ভাবে সঞ্চিত হয়ে অবস্থান করে তখন তাকে উলম্ব ভাবে সঞ্চিত আগ্নেয় শিলা বলে।
যেমন- ডাইক, ব্যাথোলিথ ইত্যাদি।