পলি সঞ্চিত হয়ে যে শিলার উদ্ভব তাকেই পাললিক শিলা বলা হয়।
পাললিক শিলা
ভূপৃষ্ঠের উপর অবস্থিত প্রাথমিক বা আগ্নেয় শিলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা যেমন বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, বৃষ্টিপাত দ্বারা যুগ যুগ ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে নুড়ি, কাকর, বালি, কাদা, পলি ইত্যাদি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পদার্থের পরিণত হয়। এই সকল সূক্ষ্ম পদার্থ সমূহ বায়ুপ্রবাহ, জলস্রোত, হিমবাহ বা অনেক সময় মানুষের কার্যাবলীর দ্বারা বাহিত হয়ে সমুদ্রগর্ভে বা জলাশয়ে স্তরে স্তরে জমা হয়। এইভাবে বহু বছর ধরে জমা হতে হতে ভূ-গর্ভের তাপে ও উপরিস্থ জলরাশি বা উপাদান সমূহের চাপে জমাট বেঁধে যে শিলার সৃষ্টি করে তাকেই পাললিক শিলা বলে।
পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য
১) পাললিক শিলায় জীবাশ্ম দেখা যায়।
২) এই শিলায় স্তর ভেদ দেখা যায় বলে একে স্তরীভূত শিলা বলে।
৩) দীর্ঘদিন সমুদ্রের তলদেশে পলি জমা হয়ে মূলত এই শিলা গড়ে উঠেছে।
৪) পাললিক শিলা অত্যন্ত নরম এবং সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
৫) এই শিলা অনান্য শিলার থেকে হালকা।
৬) পাললিক শিলায় কোনরকম স্ফটিক লক্ষ্য করা যায় না।
৭) এই শিলায় সছিদ্রতা (Porosity) লক্ষ্য করা যায়।
৮) এই শিলায় খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়।
৯) এই শিলা চকচকে এবং সুন্দর নয়।
১০) পাললিক শিলায় কাদায় চিড় খাওয়া দাগ (Mud Cracks) ও সমুদ্রগর্ভে সৃষ্ট বলে অনেক সময় ঢেউয়ের মতন চিহ্ন (Ripple Mark) দেখা যায়।
পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ
পাললিক শিলাকে মূলত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-
1) পললের উৎপত্তি অনুসারে গঠিত পাললিক শিলা
2) পললের গঠন অনুসারে গঠিত পাললিক শিলা।

1) উৎপত্তি অনুসারে পাললিক শিলা
উৎপত্তি অনুসারে গঠিত পাললিক শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
১) সংঘাত শিলা
যখন কোন শিলা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নুড়ি, বালি, শিলা চূর্ণ ইত্যাদিতে পরিণত হয় এবং পরিবর্তিত হবার সময় তাদের মূল রাসায়নিক উপাদান পরিবর্তিত হয় না তাকে সংঘাত শিলা বলে।
উদাহরণ– কংগ্লোমারেট
- এই সংঘাত শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i) স্থলজাত সংঘাত পাললিক শিলা:
অনেক সময় ভূপৃষ্ঠের স্থল ভাগের উপরে পলি সঞ্চিত হয়ে যে পাললিক শিলার সৃষ্টি ঘটায় তাকে স্থলজাত সংঘাত পাললিক শিলা বলে।
এই শিলা সাধারণত স্তরীভূত বা সামান্য স্তরীভূত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। ইহা অসংবদ্ধ অবস্থায় বালি বা হিমবাহ গ্রাবরেখা ও অন্যান্য প্রস্তরখন্ডে সৃষ্টি করে।
বায়ু তাড়িত সূক্ষ্ম বালু দ্বারা গঠিত কিছুটা অসংঘবদ্ধতা প্রাপ্ত শিলাকে লোয়েস বলে।
ii) জল সঞ্চিত সংঘাত পাললিক শিলা:
সংঘাত জনিত পাললিক শিলার অধিকাংশই জলে সঞ্চিত পাললিক শিলার অন্তর্গত।
২) অসংঘাত পাললিক শিলা
যে সমস্ত পাললিক শিলা সংঘাত ব্যতীত যেমন ভূ-সংযোগ, ভূমি বিপর্যয় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি, পাথর প্রভৃতি জমাট বেঁধে ক্রমে পাললিক শিলা গঠিত হয়। তাদের অসংঘাত পাললিক শিলা বলে।

2) গঠন অনুসারে পাললিক শিলা
পললের গঠন অনুসারে পাললিক শিলাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১) যান্ত্রিক উপায় গঠিত পাললিক শিলা
২) জৈব উপায় গঠিত পাললিক শিলা
৩) রাসায়নিক উপায় গঠিত পাললিক শিলা
১) যান্ত্রিক উপায় গঠিত পাললিক শিলা
যে সমস্ত পলি বা শিলাচূর্ণ তাদের মূল শিলার গুন ও ধর্ম অখুন্ন রেখে যান্ত্রিক উপায়ে জমাট বেঁধে যে শিলা গড়ে ওঠে তাকে বলা হয় যান্ত্রিক উপায় গঠিত পাললিক শিলা।
উদাহরণ– বেলেপাথর, কাদাপাথর, সেল
- যান্ত্রিক উপায় গঠিত পাললিক শিলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i) প্রস্তরময় পাললিক শিলা:
যখন কোন পাললিক শিলায় 50% বা তার বেশি স্থানে 2mm এর বেশি ব্যাস যুক্ত শিলা খন্ড পাওয়া যায় তাকে প্রস্তরময় পাললিক শিলা বলে।
যেমন– কংগ্লোমারেট, ধ্রেনিয়া, ব্রেকশিয়া
ii) বালুকাময় পাললিক শিলা:
0.06mm – 2.0mm ব্যাস যুক্ত কণা দিয়ে পাললিক শিলা গঠিত হয় তখন তাকে বালুকাময় পাললিক শিলা বলে।
যেমন– বেলেপাথর, কোয়াটর্জ
iii) কর্দমময় পাললিক শিলা:
0.06 mm এর কম ব্যস যুক্ত কণা দ্বারা গঠিত পাললিক শিলাকে কর্দমময় পাললিক শিলা বলে।
যেমন– কাদাপাথর
২) রাসায়নিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা:
জলে দ্রবীভূত বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ অধক্ষেপিত হয়ে শিলা গঠন করলে তাকে রাসায়নিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা বলে।
- এই জাতীয় শিলা পাঁচ প্রকার-
i) কার্বনেট জাতীয়:
জলের সাথে CO2 যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়াম কার্বনেট গঠিত হয়। এরপর কোন কারণে দ্রবনের জল শুকিয়ে গেলে CaCO3 সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলা গঠন করে।
উদাহরণ– ডলোমাইট
ii) সালফেট জাতীয়:
ক্যালসিয়াম সালফেট যুক্ত জল বাষ্পীভূত হলে স্তরে স্তরে প্রচুর পরিমাণে CaSO4 সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলা গঠন করে।
উদাহরণ– জিপসাম
iii) লৌহপ্রস্তর:
বৃষ্টির জলের সঙ্গে অনেক সময় লোহা মিশে যায়। এই জল বাষ্পীভূত হলে লোহা তলদেশে সঞ্চিত হয়ে এ ধরনের শিলা গঠন করে।
যেমন– হেমাটাইট, লিমনাইট
iv) ক্লোরাইডস:
সমুদ্রের জলে প্রচুর পরিমাণে Nacl থাকে। জল বাষ্পীভূত হলে লবণ পদার্থগুলো স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলা গঠন করে।
উদাহরণ– খনিজ লবণ
v) সিলিকেট জাতীয়:
অনেক সময় জলের সঙ্গে সিলিকেট দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। জল বাষ্পীভূত হলে সিলিকেট জমাট বেঁধে এই শিলার সৃষ্টি করে।
যেমন– চার্ট, ফিল্ট
৩) জৈব পদার্থ দ্বারা সৃষ্ট পাললিক শিলা:
সঞ্চিত জৈব পদার্থ বা জীবদেহ চাপের ফলে যে শিলা গঠন করে তাকে জৈব বা জৈবিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা বলে।
- ইহা চার প্রকার। যথা-
i) চুনময়:
প্রাণীদের কঙ্কাল ও দেহাবরণ চুন দ্বারা গঠিত। এদের মৃত্যুর পর সেই অদ্রাব্য চুন জাতীয় পদার্থ সমুদ্র বক্ষে সঞ্চিত হয়ে শৈলিভূত হয় ও পাললিক শিলা গঠন করে।
যেমন– চুনাপাথর, ডলোমাইট
ii) কার্বনময়:
প্রচুর পরিমাণে লতা, বৃক্ষ, গাছপালা বা বনভূমি ভূমিকম্প বা অন্য কোন কারণে মাটির নিচে চাপা পড়ে এই জাতীয় শিলা সৃষ্টি করে।
উদাহরণ– লিগটাইট, বিটুমিনাস
iii) বালুকাময়:
স্পঞ্জ, ডায়াটম প্রভৃতি প্রাণীর দেহাবশেষ সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকে। এই সমস্ত প্রাণী সমুদ্রের তলদেশে চাপের ফলে বালুকাময় পাললিক শিলার সৃষ্টি করে।
উদাহরণ– ডায়োটম
iv) লৌহময়:
অনেক সময় দেখা যায় কোন জলাশয়ে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে যাদের দেহ থেকে লৌহ নিঃসৃত হয় এবং জলে দ্রবীভূত লোহার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। বহু বছর ধরে এই স্তর জমাট বেঁধে যে পাললিক শিলা সৃষ্টি করে তাকে লৌহময় পাললিক শিলা বলে।
উদাহরণ– লৌহ, প্রস্তর